Subscribe Us

মুকুন্দ চক্রবর্তী : “চণ্ডীমঙ্গল” কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি




প্রকৃত নাম – সুকুমার সেন –এর মতে ‘মুকুন্দ’।

কিন্তু রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর “বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব” গ্রন্থে কবির নাম ‘মুকুন্দরাম’ বলে উল্লেখ করেছেন।

তবে ‘রাম সংযুক্ত মুকুন্দ’ এই নামের কোন প্রমান পাওয়া যায় না।

জন্ম – ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে।

জন্মস্থান – পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার রায়না থানার অন্তর্গত দামুন্যা বা দামিন্যা গ্রাম।

আদি নিবাস – কবির পূর্বপুরুষ মাধব ওঝার নিবাস ছিল কর্ণপুর। পরে দেবসেবার দায়িত্ব নিয়ে তিনি দামুন্যায় বসবাস শুরু করেন।

কৌলিক উপাধি – মিশ্র।

পিতা – হৃদয় মিশ্র।

মাতা – দৈবকী দেবী।

পিতামহ – জগন্নাথ মিশ্র।

ভ্রাতা – কবিচন্দ্র।

সন্তান – ২ পুত্র ও ২ কন্যা। যথাক্রমে – মহেশ ও শিবরাম এবং যশোদা ও চিত্রলেখা।

উপাধি – কবিকঙ্কণ। উপাধি টি কবির আশ্রয়দাতা রাজা রঘুনাথ রায় দিয়েছিলেন।

কিন্তু সুকুমার সেন –এর মতে –

“কবিকঙ্কণ’ উপাধি নয়, উপাধি হইলে দাতার উল্লেখ অবশ্যই কোন না কোন ভণিতায় থাকিত। এটি স্বয়ং গৃহীত উপনাম।“

কর্ম জীবন – জন্মস্থানে কবির জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। কবি বলেছেন – “দামিন্যায় চাষ চাষি।“ তালুকদার গোপীনাথ নন্দীর জমি চাষ করতেন।

আনুমানিক ১৫৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কবি পৈতৃক নিবাস ত্যাগ করে মেদনীপুর জেলার আড়রা গ্রামে আশ্রয় নিলে তিনি সেখানে রাজা বাঁকুড়া রায়ের পুত্র রঘুনাথ –এর গৃহশিক্ষক রূপে নিযুক্ত হন।


    • কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী কে ইংরেজ কবি চসার –এর সাথে তুলনা করা হয়।

     

    • সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মুকুন্দ চক্রবর্তী সম্পর্কে বলেছেন –

    “এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইতেন, তাহাতে সংশয়মাত্র নাই।“

     

    • কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী –র রচিত কাব্যের নাম  “অভয়ামঙ্গল”

    রাজা রঘুনাথ রায় –এর পৃষ্ঠপোষকতায় কবি কাব্য টি রচনা করেন।

    কবি নিজে তাঁর এই কাব্যটি কে “নূতন মঙ্গল” নামে আখ্যায়িত করেছেন।

    কবির এই কাব্য টি “চণ্ডীমঙ্গল” এবং “কবিকঙ্কণ চণ্ডী” (নাম টি কবির দেওয়া বলে অনুমান) নামে অধিক পরিচিত।

     

    কাব্যের রচনাকাল – কবির “অভয়ামঙ্গল” কাব্য টি রামজয় বিদ্যাসাগর –এর সম্পাদনায় সর্বপ্রথম ১৮২৩ – ২৪ খ্রিষ্টাব্দে (১৭৪৫ শক) মুদ্রিত হয়। মুদ্রিত এই গ্রন্থের শেষে কালজ্ঞাপক কয়েক ছত্র মুদ্রিত হয়। সেটি নিম্নরূপ –

    “শাকে রস রস বেদ শশাঙ্ক গণিতা

    কতদিনে দিলা গীত হরের বনিতা।

    অভয়ামঙ্গল গীত গাইল মুকুন্দ।

    আসোর সহিত মাতা হইবে সানন্দ”।

    ‘রস’ কে ৯ ধরলে দাঁড়ায় ৯৯৪১ (অঙ্কস্য বামাগতি) = ১৪৯৯ শক অর্থাৎ ১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দ (১৪৯৯ + ৭৮)।

     

    কবির এই কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে সমালোচকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেন। নিম্নে সেগুলি উল্লেখগ করা হল –

    • সুকুমার সেন কাব্য রচনার কাল নির্ধারণ করেন ১৫৫৫ – ৫৬ খ্রিষ্টাব্দ।

    • শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, ১৫৭৮ খ্রিষ্টাব্দে কবি তাঁর কাব্য রচনা শুরু করেন এবং কাব্যার রচনাকাল ১৫৭৯ খ্রিষ্টাব্দ।

    • দীনেশচন্দ্র সেন ১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দ কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী –র দামিন্যা গ্রাম ত্যাগ ও কাব্য রচনার সময় বলে নির্ধারণ করেন।


    • আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর “বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস” গ্রন্থে বলেছেন –

    “১৫৯৪ – ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কাব্য রচনা সমাপ্ত হয়"।


    • সুখময় মুখোপাধ্যায় বলেছেন –

    “মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের রচনা শেষ হয়েছিল মানসিংহের শাসনকালে, অর্থাৎ ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে"।


    • অন্যদিকে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত” (২ য় খণ্ড) –এ জানিয়েছেন –

    “১৫৭৭ সালে মুকুন্দরাম ঘর ছাড়িলে এবং স্বপ্নাদেশ লাভ করিবার চৌদ্দ – পনের বৎসর পরে কাব্য রচনায় প্রবৃত্ত হইলে স্বাভাবিকতার খুব বেশি হানি হইবে না। কিন্তু ইহার মধ্যে যাঁহারা রঘুনাথ রায়ের রাজ্যকাল কে (১৫৭৩ – ১৬০৩) তুরুপ হিসাবে ব্যবহার করিবেন, তাঁহারাই উপস্থিত ক্ষেত্রে জিতিয়া যাইবেন"।
     

    • ডিহিদার মামুদ শরিফ –এর অত্যাচারে কবি স্বগ্রাম ত্যাগ করেন এবং গন্তব্যহীন কবি এসে পৌঁছান কুচুট শহরে। এই কুচুট শহরে কবি ঘুমের মধ্যে দেবী চণ্ডী –র স্বপ্নাদেশ পান কবিতা রচনার জন্য।

    • চণ্ডীমঙ্গল” কাব্যের ২ টি খণ্ড। যথা –

    ১। আখেটিক খণ্ড

    ২। বণিক খণ্ড।

    কিন্তু সুকুমার সেন –এর মতে “অভয়ামঙ্গল” কাব্যের ৩ টি খণ্ড বর্তমান। সেগুলি হল –

    ১। দেব খণ্ড

    ২। আখেটিক খণ্ড

    ৩। বণিক খণ্ড।

     

    • কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী পয়ার ত্রিপদী ছন্দেই তাঁর কাব্য টি রচনা করেন। মিশ্র কলাবৃত্ত ছন্দের ত্রিপদী রীতিতেই আধিকাংশ রচনা।

     

    • এই কাব্যের আত্মকাহিনি তে কবি গৌড়বঙ্গ উৎকলের শাসনকর্তা হিসেবে মানসিংহ –এর নাম উল্লেখ করেছেন।

     

    • “অভয়ামঙ্গল” কাব্যে ব্যবহৃত প্রবাদ – প্রবচন প্রসঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন –

    “প্রবাদ বা প্রবচন জাতীর সুদীর্ঘ ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ততম রসাভিব্যক্তি"।

    ব্যবহৃত প্রবাদ – প্রবচন :

    ১। আপনি রাখিলে রহে আপনার মান।

    ২। ছেঁড়া ধুতি কোঁচালম্ব।

    ৩। পিপীড়ার পাখা উঠে মরিবার তরে।

    ৪। সাপিনী বাঘিনী সতা পোষা নাহি মানে।

     

    • ডঃ পার্থ চট্টোপাধ্যায় মুকুন্দ চক্রবর্তী –র “অভয়ামঙ্গল” কাব্য সম্পর্কে বলেছেন –

    “মুকুন্দরামের কাব্যে সমাজচিত্র ইতিহাসের দিক থেকে ষোড়োশ শতকের বঙ্গদেশের এক মূল্যবান অ্যালবাম"।

     

    • তপনকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন –

    “ষোড়োশ শতকের বাংলা দেশের সমাজ ইতিহাসের অনবদ্য দলিল মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্য”।

     

    চরিত্র – দেবী চণ্ডী, মহাদেব, দক্ষ, নীলাম্বর (কালকেতু আবির্ভাবের জন্য ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর চরিত্রের আয়োজন), ধর্মকেতু, কালকেতু, ফুল্লরা, খুল্লনা (বণিক খণ্ডের নায়িকা, স্বর্গভ্রষ্টা রত্নমালার প্রতিরূপ), মুরারী শীল, ভাঁড়ু দত্ত, শ্রীমন্ত।


    Post a Comment

    1 Comments