Subscribe Us

রবীন্দ্রোত্তর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

রবীন্দ্রোত্তর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত :


রবীন্দ্রোত্তর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত || সুধীন্দ্রনাথ দত্ত || রবীন্দ্রোত্তর কবি || Banglasahitto ||


রবীন্দ্রোত্তর কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত :

রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কাব্যধারার অন্যতম পথিকৃত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০) যেন এক নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা। ব্যক্তিগত অনুভূতি তাঁর কবিতায় বিশ্ববেদনায় স্তম্ভিত হয়ে গেছে।তাঁর কাব্যসম্ভার যেন এক হতাশ বন্ধ্য নায়কের হাহাকার। সভ্যতার মর্মস্থলেই সেই হাহাকারের উৎস। গ্যেটের মানবতাবাদ ও মঙ্গলধর্মে বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেমন বোদলেয়রের নারকীয় আবির্ভাব, তেমনি রবীন্দ্রনাথের নন্দনতত্ত্ব ও শুভবাদের বিরুদ্ধে সুধীন্দ্রনাথের নেতিবাদ ও শূন্যবাদী ঘোষণা। 

জন্ম - ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে অক্টোবর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কলকাতার হাতিবাগানে জন্মগ্রহণ করেন।

পিতা - হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রসিদ্ধ অ্যাটর্নি।

মাতা - ইন্দুমতী বসুমল্লিক, ছিলেন কলকাতার পটলডাঙ্গার প্রসিদ্ধ বসুমল্লিক বংশের প্রবোধচন্দ্র বসুমল্লিকের একমাত্র কন্যা এবং স্বনাম খ্যাত রাজা সুবোধচন্দ্র বসুমল্লিকের ভগ্নী।

শিক্ষাজীবন - ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কাশিতে অ্যানি বেসান্ত স্থাপিত ফিয়সফিকাল স্কুলে ভর্তি হন।

এরপর তিনি ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ফিরে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি হন এবং ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

এরপর ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট আর্টসে ভর্তি হন।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ডিস্টিংশন সমেত বি.এ পরীক্ষায় পাস করেন।

১৯২২ থেকে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি নিয়ে এম এ তে ভর্তি হন এবং সাথে সাথে ল -এর পড়াশোনা করেন কিন্তু তিনি কোন পরীক্ষা দেননি।

কর্মজীবন - ১৯২২ থেকে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি পিতার কাছে অ্যাটর্ণিশিপের শিক্ষানবিশী করেন।

১৯২৮ থেকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত 'ফরওয়ার্ড' দৈনিক পত্রের সম্পাদকীয় বিভাগের অবৈতনিক কর্মী ছিলেন।

১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি 'স্টেটসম্যান পত্রিকা'র সহ-সম্পাদক রূপে কাজ করেন।

এরপর তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।

দাম্পত্য জীবন - প্রথম পত্নী শ্রীমতি ছবি বসুর সাথে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে জুলাই তাঁর বিবাহ হয়।

তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে মে শ্রীমতি রাজেশ্বরী বসুদেবের সাথে।

পত্রিকার সম্পাদনা - ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৫ বছর তিনি ত্রৈমাসিক 'পরিচয় পত্রিকা' এবং তারপর ৭ বছর মাসিক 'পরিচয় পত্রিকা' সম্পাদনা করেন।

মৃত্যু - ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে জুন তার আকস্মিক ভাবে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের জীবনাবসান হয়।

 

  • স্কটিশ চার্জে কলেজে পড়ার সময় তাঁর খুড়তুতো ভাই সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত 'নাট্য প্রতিভা পত্রিকা'য় বেনামে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটি অনুবাদ কবিতা প্রকাশিত হয়।
  • সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ "তন্বী" (১৯৩০)।
  • সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম প্রকাশিত কবিতা "কুক্কুট" ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে 'প্রবাসী পত্রিকা'য় প্রকাশিত হয়।

তবে তাঁর প্রথম কবিতাটির জন্ম ইতিহাস বিচিত্র ও কৌতুকময়। একদিন কবিতার বিষয়ে গৌরবের মূল্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর বিতর্ক বাঁধে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে মোরগের ওপর একটি কবিতা লিখতে বলেন। তার কয়েকদিন পর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত "কুক্কুট" কবিতাটি রচনা করেন এবং নিয়ে আসেন কবিগুরুর কাছে। তাঁর কবিতাটি পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন -

"না, তুমি জিতেছ"।

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এই কবিতাটি 'ভারতবর্ষ' এবং 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকা ছাপতে প্রত্যাখ্যান করে। তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশেই তাঁর "কুক্কুট" কবিতাটি 'প্রবাসী পত্রিকা'য় প্রকাশিত হয়। প্রথম কবিতা রচনা করেই তিনি কবিগুরুর স্নেহ এবং প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।

  • কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে বাংলা কবিতায় ধ্রুপদী রীতির প্রবর্তক বলা হয়।
  • শঙ্খ ঘোষ সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে তাঁর "ছন্দের বারান্দা" গ্রন্থে বলেছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ১৩০ টি মৌলিক কবিতার মধ্যে ৯০ টি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচনা করেন এবং ৩০ টি কবিতায় তিনি ছন্দের ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা চালিয়েছেন। বাকি ১০ টি স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত রচিত কাব্যগ্রন্থ :

১. তন্বী ১৯৩০

২. অর্কেষ্ট্রা ১৯৩৫

৩. ক্রন্দসী ১৯৩৭

৪. উত্তর ফাল্গুনী ১৯৪০

৫. সংবর্ত ১৯৫৩

৬. প্রতিধ্বনি ১৯৫৪

৭. দশমী ১৯৫৬

৮. বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত "সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্য সংগ্রহ" ১৯৬২

 

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত রচিত গদ্য প্রবন্ধ :

১. স্বগত ১৯৩৮

২. কুলায় ও কালপুরুষ ১৯৫৭

৩. সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধ সংগ্রহ ১৯৮৩ (অমিয় দেব সম্পাদিত)

৪. আত্মজীবনীর খসড়া

 

আত্মজীবনীমূলক ইংরেজি রচনা :

1.     1. The world of Twilight 1970

 

তন্বী” (১৯৩০) -

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।

তিনি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ পত্রে তিনি লেখেন –

 “ঋণ শোধের জন্য নয়, ঋণ স্বীকারের জন্য” 

এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি ১৯২৬ থেকে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচনা করেন।

এই কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ২৯ টি।

এই কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা – “তন্বী সে যে”, “শ্রাবণ বন্যা”, “পলাতকা”, “বর্ষার দিনে”, “স্মরণ”, “মানবী”, “অনাহূত”, “কৈফিয়ৎ”, “অভিসার”।

 

অর্কেষ্ট্রা” (১৯৩৫) -

এই কাব্যগ্রন্থ থেকে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্বকীয়তার প্রকাশ।

এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রেম কাব্যগ্রন্থ।

এই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে কবি কাব্যগ্রন্থটি সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গ করেন।

বিদেশিনী নারীর প্রেম কবি হৃদয়ে যে নব নব ভাব সঞ্চার করেছিল তারই সহজ প্রকাশ ঘটেছে এই কাব্যগ্রন্থে।

এই কাব্যগ্রন্থে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন ক্ষণস্থায়ী প্রেমের চিরস্থায়ী আর্তি।

১৯২৯ থেকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি কবি রচনা করেন।

এই কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ২৫ টি।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা – “হৈমন্তী”, “ধিক্কার”, “অর্কেষ্ট্রা”,‌ “বিস্মরণী”, “চপলা”।

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্রথম সংস্করণে কাব্যগ্রন্থটির বানান "অর্কেষ্ট্রা" থাকলেও ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে বানান হয়েছে "অর্কেস্ট্রা"

 

ক্রন্দসী” (১৯৩৭) -

কবি তার এই কাব্যগ্রন্থটি তার প্রিয় বন্ধু হমফ্রে হাউস কে উৎসর্গ করেন।

এই কাব্যগ্রন্থে মোট ২৪টি কবিতা বর্তমান।

এই কাব্যগ্রন্থের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কবিতা "উটপাখি"।

অন্যান্য কবিতা – “সমাপ্তি”, “মৃত্যু”, “প্রশ্ন”, “প্রার্থনা”, “কুক্কুট”, “বর্ষশেষ”, “অকৃতজ্ঞ”।

 

উত্তর ফাল্গুনী” (১৯৪০) -

কাব্যগ্রন্থটি প্রধানত প্রেমমূলক।

কবি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটি সুমন্ত্র মহলানবিশ কে উৎসর্গ করেন।

এই কাব্যগ্রন্থে মোট ১৯ টি কবিতা রয়েছে।

এই কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা – “মরণতরী”, “নিরুক্তি”, “সংশয়”, “বিলয়”, “মহানিশা”, “জাগরণ”।

 

সংবর্ত” (১৯৫৩) -

এই কাব্যগ্রন্থটি কবি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে রচনা করেন।

কাব্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন আবু শয়ীদ আইয়ুব কে।

এই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে অধ্যাপিকা গৈরিকা ঘোষ বলেছেন -

"সংবর্ত' এক আদর্শ লালনকারী কবি পুরুষের স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণার কাব্য"

 

দশমী” (১৯৫৬) -

এই কাব্যগ্রন্থটি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ।

কবি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন অবনী ভূষণ চট্টোপাধ্যায় কে।

জীবদ্দশায় প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থে মোট দশটি কবিতা বর্তমান।

১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কবি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি রচনা করেন।

এই কাব্যগ্রন্থের "উপস্থাপন" কবিতায় কবি নিজেকে 'ক্ষণবাদী' বলে ঘোষণা করেছেন।

এই কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতা – “নৌকাডুবি”, “ভ্রষ্ট তরী”, “নষ্টনীড়”, “তীর্থ পরিক্রমা”।

 

প্রতিধ্বনি” (১৯৫৪) -

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র অনূদিত কাব্য।

কবি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন ইন্দিরা সুশীল কুমার কে।

এই কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ৫৫ টি।

ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান – এই তিন ভাষায় লেখা এগারোজন কবির অনুবাদে সমৃদ্ধ এই কাব্যগ্রন্থ।

 

স্বগত” (১৯৩৮) -

সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ।

তিনি তার এই প্রবন্ধ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কে।

এই প্রবন্ধ গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ – “কাব্যের মুক্তি”, “ছন্দোমুক্তি ও রবীন্দ্রনাথ”, “বাংলা ছন্দের মূল সূত্র”, “চোরাবালি”, “অন্তঃশীলা”।

 

  • জীবনানন্দ দাশ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে বলেছেন -

"তিনি আধুনিক বাংলা কাব্যের সবচেয়ে বেশি নিরাশা করোজ্জ্বল চেতনা"।


আরও পড়ুন -


Thank You

For More Update Visit Our Website Regularly:

www.banglasahitto.in 

Contact Us On:

Mail: contact@banglasahitto.in

To join our FB Page - CLICK HERE.

Post a Comment

1 Comments