যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত |
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত : দুঃখবাদী কবি
জন্ম – যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত পুর্ব বর্ধমান জেলার কালনা
মহাকুমার অন্তর্গত পাতিলপাড়া গ্রামে মাতুলালয়ে ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ শে জুন তিনি জন্মগ্রহণ
করেন।
পিতা - দ্বারকানাথ
সেনগুপ্ত।
পৈতৃক নিবাস - নদীয়া
জেলার শান্তিপুরের নিকটবর্তী হরিহর গ্রাম।
শিক্ষাজীবন - ১৯১১
খ্রিষ্টাব্দে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন - তাঁর কর্ম জীবনের সূচনা হয় ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট
ইন্ডিয়ান রেলওয়ের সার্ভেয়রের কাজ দিয়ে।
এরপর তিনি ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নদীয়ার কৃষ্ণনগর ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের অধীনে ওভারসিয়ারের
কাজে যোগ দেন।
পত্নী - হাজারিবাগের উকিল চারুচন্দ্র গুপ্তের কন্যা জ্যোতির্লতা
দেবী। তাঁর “মন্ত্রহীন” কবিতায় তিনি স্ত্রীর নাম উল্লেখ করে লিখেছেন,
“হে আমার জ্যোতি হে আমার সতি
গৃহিণী, সচিব, সখী হে প্রিয়া”।
সন্তান – ৩ পুত্র অরুণকান্তি, তরুণকান্তি ও সুনীলকান্তি এবং
৪ কন্যা শুভ্রা, শুক্লা, শ্যামলী ও নীলা।
ছদ্মনাম - বিপ্রতীপ
গুপ্ত।
উপাধি – ইঞ্জিনিয়ার কবি, দুঃখবাদী কবি, মরু কবি।
মৃত্যু – ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ই সেপ্টেম্বর মাত্র ৬৭ বছর
বয়সে ইঞ্জিনিয়ার কবি পরলোকগমন করেন।
- রবীন্দ্র যুগের কবি হয়েও রবীন্দ্রনাথের প্রভাব এড়িয়ে যে কয়জন কবি-সাহিত্যিক নতুন ভাবনা ও স্বতন্ত্র বক্তব্য নিয়ে কাব্যচর্চা করেন, যতীন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম।
কাজী নজরুল ইসলাম : রবীন্দ্র পরবর্তী ‘প্রথম মৌলিক কবি’ |
- যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও জীবনে প্রথম লেখেন “প্রত্নমূলক গবেষণা” নামক গদ্য (প্রবন্ধ)।
- কৃষ্ণনগরে কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সাথে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর পরিচয় ঘটে এবং তিনিই কবিকে
কবিতা লেখায় অনুপ্রাণিত করেন।
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর প্রথম কবিতা
“শীত” ১৩১৭ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
- ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ৩৬ বছর
বয়সে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ “মরীচিকা” প্রকাশিত
হয়।
- যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত –এর প্রথম প্রকাশিত কাব্য সংকলন “অনুপূর্বা”। কাব্য সংকলন টি ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই কাব্য সংকলনে মোট ১০২ টি কবিতা রয়েছে।
শঙ্খ ঘোষ : “মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে”-র কবি |
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত কাব্যগ্রন্থ:
১. মরীচিকা (১৯২৩)
২. মরুশিখা (১৯২৭)
৩. মরুমায়া (১৯৩০)
৪. সায়ম (১৯৪০)
৫. ত্রিযামা (১৯৪৮)
৬. নিশান্তিকা (১৯৫৭)
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত কাব্য সমালোচনামূলক গ্রন্থ:
১. কাব্যপরিমিতি (১৯৩১)
গ্রন্থ টি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত
উৎসর্গ করেছিলেন কালিদাস রায় কে।
গ্রন্থ টি ‘উপাসনা পত্রিকা’য় ১৩৩৭ থেকে ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হয়।
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত -এর অনূদিত কাব্যগ্রন্থ:
১। কুমারসম্ভব (১৩৫৫ বঙ্গাব্দ)
২। গান্ধিবাণী কনিকা (১৩৫৫ বঙ্গাব্দ)
৩। প্রাচীন মেয়ে (১৩৫৫ বঙ্গাব্দ)
৪। রথী ও সারথী (১৩৫৭ বঙ্গাব্দ)
৫। ম্যাকবেথ (মাসিক "বসুমতী" পত্রিকায় প্রকাশিত)
৬। ওথেলো (মাসিক "বসুমতী" পত্রিকায় প্রকাশিত)
৭। হ্যামলেট ("শনিবারের চিঠি" পত্রিকায় প্রকাশিত)
৮। এ্যান্টনি ও ক্লিওপেট্রা (১৩৬১ বঙ্গাব্দ)
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রচিত কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত
আলোচনা:
“মরীচিকা” (১৯২৩) –
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের প্রথম
প্রকাশিত এবং শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ।
এই কাব্যগ্রন্থ টি তিনি উৎসর্গ
করেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী কে।
কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা
৪৭ টি।
কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা
“বহ্নিস্তুতি” এবং শেষ কবিতা টি হল “আহুতি”।
এই কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা “শিবের গাজন”, “মানুষ”, “হাট”, “আবেদন”, “বারনারী”, “চাষার বেগার” প্রভৃতি।
পত্রিকায় সাহিত্যিকদের প্রথম আত্মপ্রকাশ |
“মরুশিখা” (১৯২৭) –
দ্বিতীয় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।
এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা
“শিবস্তোত্র” এবং শেষ কবিতা “গঙ্গাস্তোত্র”।
কাব্যগ্রন্থ টি যতীন্দ্রনাথ
সেনগুপ্ত উৎসর্গ করেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী কে।
এই কাব্যগ্রন্থের মোট কবিতা
সংখ্যা ৪১ টি।
“মরুমায়া” (১৯৩০) –
কাব্যগ্রন্থ টি যতীন্দ্রনাথ
সেনগুপ্ত উৎসর্গ করেন স্ত্রী শ্রীমতি জ্যোতি দেবী কে।
কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা
“অন্বেষণ” এবং শেষ কবিতা “দীপ পতঙ্গ”।
“মরুমায়া” কাব্যের বিখ্যাত কবিতা “নবান্ন” কবিতাটি নবান্ন উৎসব কে কেন্দ্র করে কবি নিজেকে কৃষকের ভূমিকায় রেখে যে দুঃখজনক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তাই ‘বন্ধুরূপী’ ঈশ্বরকে ব্যক্ত করেছেন। কবিতাটি ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে রচিত।
নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত বিভিন্ন রচনা |
একনজরে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত:
- যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রবীন্দ্র যুগের প্রথম বিদ্রোহী কবি। ‘দুঃখবাদী কবি’ নামেও তিনি পরিচিত।
- বাংলা সাহিত্যের প্রথম ‘ইঞ্জিনীয়র কবি’ যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
- “মরীচিকা” কাব্যের প্রথম কবিতা - “বহ্নিস্তুতি”।
- “মরুশিখা” কাব্যের প্রথম কবিতা - “শিবস্ত্রোত”।
- “মরুমায়া” কাব্যের প্রথম কবিতা - “অন্বেষণ”।
- যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত -এর “রেলঘুম” এবং “অন্ধকার” কবিতা ২ টি ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
- যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত –এর লেখা শেষ কবিতা “আসছে জন্মে”, কবিতা টি ১৩৬০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।
- যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের সাথে পাশ্চাত্য কবি ও ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির সাদৃশ্য রয়েছে।
টমাস হার্ডি যেমন মধ্য ভিক্টোরীয়
যুগের নির্লিপ্ততা ও প্রশান্তি থেকে যুদ্ধোত্তর বাস্তব চেতনার দিকে ইশারা করেছেন, যতীন্দ্রনাথ
সেনগুপ্ত ও সেই রকম রবীন্দ্র কাব্যের স্বপ্নলুতা থেকে সাম্প্রতিক বাস্তবতায় উত্তরণের
স্বাভাবিক হেতু নির্মাণ করেছেন।
- যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত বাংলা কাব্য জগতের প্রথম কবি যাঁর কাব্যে বেদনা, রিক্ততা, হতাশা, ব্যর্থতার করুণ ক্রন্দন শোনা গেছে। দুঃখের বহ্নিজ্বালায় জ্বলেছে কবির কবিসত্ত্বা। মানুষের দুঃখ, বেদনা, উৎপীড়িত, লাঞ্ছিত জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এই দুঃখবাদ। তাঁর দুঃখবাদ জড়বাদী দর্শন এবং মানবপ্রীতি থেকে উদ্ভূত।
- প্রেমকে তিনি দেখেছেন নিস্ফল দাহন হিসাবে –
“যৌবনে আমি করিনু ঘোষণা
প্রেম বলে কিছু নাই
চেতনা আমার জড়ে মিশাইলে
সব সমাধান পাই”।
সাহিত্যিকদের রচিত এবং প্রকাশিত প্রথম রচনা |
- “কচিডাবের কবি” প্রবন্ধে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন -
“তাঁর ভাষায়, বক্তব্যে, উপমা – অলংকার – চিত্রকল্পে এবং একটি নিজস্ব দার্শনিকতায় যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রবীন্দ্র যুগের প্রথম বিদ্রোহী কবি”।
- শশীভূষণ দাশগুপ্ত যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত প্রসঙ্গে তাঁর “কবি যতীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম পর্যায়”
গ্রন্থে বলেছেন –
“এই সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা শস্য শ্যামলা বাঙলা মায়ের কোলে বসিয়াও এই কবি শুধু গোবি – সাহারার ভীষণা মরুমূর্তির ছবি দেখিলেন – বারিহীন দিগন্ত বিস্তৃত তপ্ত বালুকার অন্তহীন জ্বালা অনুভব করছিলেন”।
- ডঃ সুকুমার সেন কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সম্পর্কে বলেছেন, -
“দুঃখের ফ্রেমে বাঁধা হইলেও জীবনচিত্রের উজ্জ্বলতা তাঁহার কাছে কিছু কম কমনীয় নয়”।
- সমালোচক শ্রীকনক বন্দ্যোপাধ্যায় যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত সম্পর্কে বলেছেন, -
“এই দুঃখবাদ কবির বিলাসমাত্র নহে, উহা তাঁহার মর্মমূল হইতে উৎসারিত, পৃথিবী ও জীবনের প্রতি গভীর মমতাই তাঁহাকে দুঃখের কবি করিয়া তুলিয়াছে। ইহা জীবনের দুঃখ হইতে পলায়ন নহে, দুঃখময় জীবনকে গভীররূপে উপলব্ধি করিবার সাধনা”।
6 Comments
অত্যন্ত তথ্যবহুল লেখা। ধন্যবাদ।
ReplyDeleteপ্রথম কবিতার নাম কী
ReplyDeleteপ্রকাশিত প্রথম কবিতা "শীত"। 'প্রবাসী পত্রিকা'য় কবিতা টি প্রকাশিত হয়।
Deleteঅসংখ্য ধন্যবাদ 💐💐💐 আপনাদের সুচিন্তিত মতামত আমাদের সাথে ব্লগপোস্টে কমেন্ট করে কিংবা banglasahitya213@gmail.com মেল করে জানান...
ReplyDelete'মরু শীখা' কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?
ReplyDeleteVison upokrito holam thanks
ReplyDelete