Subscribe Us

বিহারীলাল চক্রবর্তী : বাংলা সাহিত্যে "ভোরের পাখি"

বিহারীলাল চক্রবর্তী : বাংলা সাহিত্যে ভোরের পাখি, বিহারীলাল চক্রবর্তী, বাংলা সাহিত্যে ভোরের পাখি, Biharilal, Biharilal Chakraborty




বিহারীলাল চক্রবর্তী : বাংলা সাহিত্যে "ভোরের পাখি"

জন্ম - বিহারীলাল চক্রবর্তী অধুনা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার জোড়াবাগান অঞ্চলের নিমতলায় ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ শে মে জন্মগ্রহণ করেন।

বিহারীলাল চক্রবর্তী –র নাম সম্পর্কে সুকুমার সেন তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস” (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে লিখেছেন - “ইনি স্বাক্ষর করিতেন বেহারীলাল”

পিতা - দীননাথ চক্রবর্তী, পুরোহিত ছিলেন। মাত্র ৪ বছর বয়সে বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর মাকে হারান।

আদি পদবি (পারিবারিক) – চট্টোপাধ্যায়। কবির প্রপিতামহ হালিশহরের কোন এক স্বর্ণ বণিকের দান গ্রহণ করায় সেই সমাজে সমাজের বিধান অনুযায়ী তাঁরা সেই সমাজ থেকে ব্রাত্য বা পতিত হন।

শিক্ষা জীবন - বিহারীলাল চক্রবর্তী জেনারেল এসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেন।

তারপর তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ৩ বছর অধ্যয়ন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন সহপাঠী।

দাম্পত্য জীবন - ১৯ বছর বয়সে বিহারীলাল চক্রবর্তী ১০ বছর বয়সী অভয়া দেবী (সরলা দেবী) কে বিবাহ করেন। কিন্তু ৪ বছর পর মৃত সন্তান প্রসব করে তিনি মারা যান। “বন্ধুবিয়োগ” (১৮৭০) কাব্যগ্রন্থের “সরলা” নামক সর্গে কবি এই বিয়োগ ব্যাথা স্মরণ করেছেন।

সরলা দেবীর মৃত্যুর ২ বছর পর বিহারীলাল চক্রবর্তী নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ২য় কন্যা কাদম্বিনী দেবী কে বিবাহ করেন। “বঙ্গসুন্দরী” (১৮৭০) কাব্যগ্রন্থের “প্রিয়তমা” নামক সর্গে কবি কাদম্বিনী দেবীর কথা গভীর অনুরাগের সাথে স্মরণ করেছেন।

উপাধি - কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাব্যগুরু বিহারীলাল চক্রবর্তী কে “ভোরের পাখি” আখ্যায় ভূষিত করেছিলেন। অক্ষয়কুমার বড়ালও বিহারীলাল চক্রবর্তী কে “ভোরের পাখি” বলেছেন।

বিহারীলাল চক্রবর্তী –র মৃত্যুর পর ‘সাধনা পত্রিকা’য় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিহারীলালের কাব্য চিন্তা নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে কবিগুরু লিখেছেন –

“সে প্রত্যুষে অধিক লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্জে বিচিত্র কলগীত কূজিত হইয়া উঠে নাই। সেই ঊষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল। সে তাহার নিজের। ঠিক ইতিহাসের কথা বলিতে পারি না, কিন্তু আমি সেই প্রথম বাংলা কবিতায় কবির নিজের সুর শুনিলাম”



ক্লিক করুণ -

অনলাইন টেস্টের জন্য



পত্রিকা সম্পাদনা – ‘পূর্ণিমা’ নামক পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা। পত্রিকা টি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে।

এরপর তিনি ‘সাহিত্য সংক্রান্তি’ নামক পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। কিন্তু এই পত্রিকা টি দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি।

এরপর ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। এই পত্রিকায় তাঁর “বঙ্গসুন্দরী” (১৮৭০), “নিসর্গসন্দর্শন” (১৮৭০) এবং “প্রেমপ্রবাহিণী” (১৮৭০) কাব্যগ্রন্থ ৩ টি প্রকাশিত হয়।

মৃত্যু - ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ২৪শে মে বহুমুত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৯ বছর বয়সে বিহারীলাল চক্রবর্তী পরলোকগমন করেন।



  • বিহারীলাল চক্রবর্তী –এর প্রথম রচনা “স্বপ্নদর্শন” নামক গদ্যগ্রন্থ। গদ্যগ্রন্থ টি তিনি সংস্কৃত কলেজে পাঠরত অবস্থায় রচনা করেন এবং ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘পূর্ণিমা পত্রিকা’য় গদ্যগ্রন্থ টি প্রকাশিত হয়।

এই গ্রন্থটি তে কবির দেশ ও দেশমাতৃকার দুর্ভাগ্যের জন্য গভীর আক্ষেপ ফুটে উঠেছে।

  • তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সঙ্গীতশতক” (১৮৬২)। কাব্যগ্রন্থ টি ১০০ টি বাংলা গানের সমষ্টি।

  • তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ সারদামঙ্গল” (১৮৭৯)। কাব্যগ্রন্থটি ৫টি স্বর্গে বিভক্ত।

বিহারীলাল চক্রবর্তী রচিত কাব্যগ্রন্থ:

১. সঙ্গীত শতক (১৮৬২)

২. বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০)

৩. নিসর্গসন্দর্শন (১৮৭০)

৪. বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০)

৫. প্রেমপ্রবাহিনী (১৮৭০)

৬. সারদামঙ্গল (১৮৭৯)

৭. মায়াদেবী (১৮৮২)

৮. শরৎকাল (১৮৮২)

৯. দেবরানী (১৮৮২)

১০. বাউল বিংশতি (১৮৮৭)

১১. সাধের আসন (১৮৮৯)

১১. গোধূলি (১৮৯৯)

১২. ধুমকেতু (১৮৯৯)

১৩. কবিতা ও সংগীত

 


আরও পড়ুন - 

বাংলা সাহিত্যে যা কিছু প্রথম



বিহারীলাল চক্রবর্তী রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা:

সঙ্গীত শতক” (১৮৬২) –

প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।

গ্রন্থ টি ১০০ টি সঙ্গীতের সমন্বয়।

এই কাব্যগ্রন্থ টি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে বিহারীলাল চক্রবর্তী ঠাকুর পরিবারের দৃষ্টি আকর্ষন করেন।

এই কাব্যগ্রন্থের সমাপ্তি সূচক কবিতা টি কবিপত্নীর উদ্দেশ্যে রচিত।

 

বঙ্গসুন্দরী” (১৮৭০) - 

কাব্যটি ১০ টি সর্গে বিভক্ত।

প্রথম সংস্করণে ছিল ৯ টি সর্গ। পরবর্তী কালে দ্বিতীয় সংস্করণে আরও একটি সর্গ সুরবালা সংযোজিত হয়।

১০ সর্গ হল যথাক্রমে – ‘উপহার’, ‘নারীবন্দনা’, ‘সুরবালা’, ‘চিরপরাধিনী’, ‘করুণা সুন্দরী’, ‘বিষাদিনী’, ‘প্রিয়সখী’, ‘বিরহিণী’, ‘প্রিয়তমা’ এবং ‘অভাগিনী’।

প্রতি টি সর্গের প্রারম্ভে একটি করে উদ্ধৃতি রয়েছে। উদ্ধৃতিগুলি কালিদাস, ভবভূতি, ভারবি এবং বাইরণের।

এই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সর্গ “নারীবন্দনা” থেকে কবি সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার তাঁর “মহিলা কাব্য” রচনার প্রেরণা লাভ করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারও বিহারীলাল চক্রবর্তীর মত অনুরূপ চেতনায় “মহিলা কাব্য” –এর সূচনায় লিখেছেন –

“গাব গীত খুলি হৃদ দ্বার

মহীয়সী মহিমার মোহিনী মহিলার”

বঙ্গসুন্দরী” কাব্য প্রসঙ্গে কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য লিখেছেন –

“নারীজাতিকে বিহারী কোমলতা, করুণাপরায়নতা এই সকল গুণে পুরুষ অপেক্ষা অনেক শ্রেষ্ঠ ভাবিতেন, সেই অভিপ্রায় উক্ত কাব্যে সুচারুভাবে ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন”

 


আরও পড়ুন - 

পত্রিকায় সাহিত্যিকদের প্রথম আত্মপ্রকাশ



নিসর্গসন্দর্শন” (১৮৭০) 

এই কাব্যগ্রন্থ টি প্রথম ‘অবোধবন্ধু পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়।

কাব্যগ্রন্থ টি মোট ৭ টি সর্গে বিভক্ত। সর্গগুলি হল – ‘চিন্তা’, ‘সমুদ্র দর্শন’, ‘বীরাঙ্গনা’, ‘নভোমণ্ডল’, ‘ঝটিকার রজনী’, ‘ঝটিকা সম্ভোগ’ এবং ‘প্রভাত’।

কাব্যের দ্বিতীয় সর্গ ‘সমুদ্র দর্শন’ পুরীর সমুদ্র দর্শনের পর লেখা।

 

বন্ধুবিয়োগ” (১৮৭০) 

কাব্যগ্রন্থ টি প্রথম ‘পূর্ণিমা পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়।

৪টি সর্গে রচিত শোককাব্য। সর্গগুলি হল – ‘পূর্ণ – বিজয়’, ‘কৈলাস’, ‘সরলা’ এবং ‘রামচন্দ্র’।

কাব্যে বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর ৪ বন্ধু - পূর্ণচন্দ্র, কৈলাস, বিজয় ও রামচন্দ্র এবং তাঁর প্রথমা পত্নী অভয়া দেবী (সরলা দেবী) -র বিয়োগ ব্যাথা ব্যক্ত করেছেন।

প্রথম সর্গ ‘পূর্ণ – বিজয়’ –এ কবি  বন্ধু পূর্ণচন্দ্র এবং বিজয় সম্পর্কে তাঁর বেদনা নিবেদন করেছেন।

দ্বিতীয় সর্গ ‘কৈলাস’ রচনা করেন বন্ধু কৈলাসের উদ্দেশ্যে।

তৃতীয় সর্গ ‘সরলা’ উৎসর্গ করেন তাঁর প্রথম পত্নীর উদ্দেশ্যে।

চতুর্থ সর্গ ‘রামচন্দ্র’ কবিবন্ধু রামচন্দ্রের স্মৃতি নির্ভর।

এই কাব্যগ্রন্থে ঈশ্বর গুপ্তের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

 

প্রেমপ্রবাহিনী” (১৮৭০) 

কাব্যগ্রন্থ টি প্রথম ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে ‘অবোধবন্ধু পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়।

৫টি সর্গে কাব্যটি রচিত। 

সর্গগুলি হল - ‘পতন’, ‘বিরাগ’, ‘বিষাদ’, ‘অন্বেষণ’, এবং ‘নির্বান’।

এই কাব্যগ্রন্থের তৃতীয় এবং পঞ্চম সর্গের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার মজুমদার Wordsworth –এর ‘Tintern Abbey’ আর ‘Shelley Alastor’ কবিতার প্রভাব লক্ষ্য করেছেন।



আরও পড়ুন - 

বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যিকদের রচিত শ্রেষ্ঠ রচনা


 

সারদামঙ্গল” (১৮৭৯) 

বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ গীতিকাব্য।

কাব্যগ্রন্থ টি ‘আর্যদর্শন পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়।

ঊষা বন্দনা দিয়ে কাব্যের শুরু -

“চরণ কমলে লেখা

আধ আধ রবি রেখা

সর্বাঙ্গে গোলাপ আভা, সীমান্তে শুকতারা জ্বলে”

মৈত্রী বিরহ, প্রীতি বিরহ এবং সরস্বতী বিরহ - এই ত্রিবিধ বিরহই ‘সারদামঙ্গল’ রচনার মূল উৎস কবি একথা স্বীকার করেছেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় - সারদামঙ্গল এক অপরূপ কাব্য”।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাট্যগ্রন্থ “বাল্মীকি প্রতিভা” (১৮৮১) –র ভাব ও ভাষার সাথে বিহারীলাল চক্রবর্তীর এই কাব্যের আশ্চর্য রকম মিল পরিলক্ষিত করা যায়।

তাঁর এই কাব্যে প্রখ্যাত ইংরেজী কবি শেলী-র Hyme to Intellectual Beauty কবিতার সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর “সাধের আসন” (১৮৮৯) কাব্যগ্রন্থের নবম সর্গ “আসনদাত্রী দেবী” তে “সারদামঙ্গল” কাব্য রচনার ইতিহাস টি সংক্ষেপে অতি নিপুণতার সাথে ব্যক্ত করেছেন।

এই কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে তারাপদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন –

“প্রকৃত বিচারে প্রথম সর্গেই সারদামঙ্গলের সমাপ্তি। কবির ভাবও এইখানে শেষ হইয়াছে। কবি যদি এইখানে কাব্য সমাপ্ত করিতেন, তাহা হইলে সারদা বিরহের দুঃখ কবি হৃদয় ত্যাগ করিয়া পাঠক হৃদয় অধিকার করিত”

 

সাধের আসন” (১৮৮৯) –

কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর এই কাব্যগ্রন্থ টি উৎসর্গ করেন কাদম্বরী দেবী কে।

কাব্যগ্রন্থের প্রথম ৩ টি সর্গ ‘মালঞ্চ পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়।

এই কাব্যগ্রন্থে কবি তাঁর কল্পিত নারী মূর্তি সারদার স্বরূপ স্পষ্টভাবে চিত্রিত করেছেন।



আরও পড়ুন - 

যে সকল লেখকগণ পিতৃদত্ত নাম গ্রহণ করেননি



বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত রচনা:

 

গ্রন্থ

পত্রিকা

স্বপ্নদর্শন (১৮৫৮)

পূর্ণিমা

বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০)

পূর্ণিমা

নিসর্গসন্দর্শন (১৮৭০)

অবোধবন্ধু

বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০)

অবোধবন্ধু

প্রেমপ্রবাহিনী (১৮৭০)

অবোধবন্ধু

সারদামঙ্গল (১৮৭৯)

আর্যদর্শন

মায়াদেবী (১৮৮২)

ভারতী

দেবরাণী (১৮৮২)

ভারতী

বাউল বিংশতি (১৮৮৭)

কল্পনা

১০

সাধের আসন (১৮৮৯)

মালঞ্চ

 

  • কবি সমালোচক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিহারীলাল চক্রবর্তী সম্পর্কে বলেছেন –

“বিহারীবাবু সর্বদাই কবিত্বে মাশগুল থাকিতেন, তাঁহার হাড়ে হাড়ে, প্রাণে প্রাণে কবিত্ব ঢালা থাকিত। তাঁহার রচনা তাঁহাকে যত বড়ো কবি বলিয়া পরিচয় দেয়, তিনি তাহা অপেক্ষা অনেক বড়ো কবি ছিলেন”

  • সুকুমার সেনের মতে - 
আধুনিক বাঙ্গালা অন্তরঙ্গ গীতিকাব্যের প্রবর্তক তিনিই”।


To join our FB Page - CLICK HERE.

Post a Comment

0 Comments