Subscribe Us

বিদ্যাপতি : বৈষ্ণব পদাবলীর আদি কবি

বিদ্যাপতি, বৈষ্ণব পদাবলী, গোবিন্দদাস, মহাপ্রভু চৈতন্যদেব, চৈতন্যদেব, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, জয়দেব, গীতগোবিন্দ, বিদ্যাপতি রচিত গ্রন্থ, কীর্তিলতা, কীর্তিপতাকা


বিদ্যাপতি : বৈষ্ণব পদাবলীর আদি কবি

জন্ম – চতুর্দশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ, ১৩৮০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময় (সমালোচকেরা বিদ্যাপতির আবর্ভাব কাল – ১৩৪৭/ ১৩৫৮/ ১৩৮০/ ১৩৯০ খ্রিষ্টাব্দ নিয়ে নানান মতামত পোষণ করেন)।

জন্মস্থান – উত্তর বিহারের দ্বারভাঙ্গা জেলার মধুবনী পরগনার অন্তর্গত বিসফী গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

পিতামহ – জয়দত্ত ঠাকুর, সংস্কৃত শাস্ত্রের পণ্ডিত ছিলেন।

পিতা – গনপতি ঠাকুর।

কৌলিক উপাধি – ঠক্কুর, বংলায় ঠাকুর।

পুত্র – হরপতি, নরপতি এবং বাচ্যপতি।

কন্যা – দুলহা, তাঁরই রচিত একটি পদ থেকে তাঁর কন্যার নাম জানা যায়।

পুত্রবধূ – চন্দ্রকলা।

উপাসক – শৈব। কারও কারও মতে তিনি পঞ্চোপাসক (শিব, বিষ্ণু, দুর্গা, সূর্য, গনেশ) ছিলেন (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বিদ্যাপতি কে "পঞ্চোপাসক হিন্দু" বলেছেন)

উপাধি 

১। মৈথিল কোকিল

২। কবি সার্বভৌম

৩। অভিনব জয়দেব

৪। নব জয়দেব

৫। নব্য কবিশেখর

৬। খেলন কবি

৭। রাজসভার কবি

৮। রসিক সভাভূষণ সুখকন্দ

তিরোধান – আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিষ্টাব্দে গঙ্গাঘাটে তিনি দেহ ত্যাগ করেন।

 

 

  • বিদ্যাপতি –র পদ প্রথম আবিষ্কার করেন জর্জ গ্রীয়ার্সন

  • পাশ্চাত্য কবি চসার –এর সাথে বিদ্যাপতি –র তুলনা করা হয়।

  • রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ১৯৭৫ সালে ‘বঙ্গদর্শন পত্রিকা’য় বিদ্যাপতি কে “মিথিলার কবি” প্রথম প্রমাণ করেন বিদ্যাপতি রচনায়।

  • কবি বিদ্যাপতি ‘কামেশ্বর’ রাজ বংশের সভাকবি ছিলেন এবং তিনি কামেশ্বর বংশের কীর্তিসিংহ থেকে ভৈরবসিংহ প্রায় ৬ জন রাজা এবং ১ জন রানীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।
  • বিদ্যাপতি মাথুর, নিবেদন, প্রার্থনা এবং ভাবানুরাগ পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কবি। 

  • কবি বিদ্যাপতি –র শ্রেষ্ঠ ভাবশিষ্য ছিলেন – গোবিন্দদাস

  • মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বিদ্যাপতি –র পদ আস্বাদন করতেন। অদ্বৈতাচার্য বিদ্যাপতি –র পদ পাঠ করে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব কে অভ্যর্থনা করেছিলেন।

  • কৃষ্ণদাস কবিরাজ –এর “শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত” –এ কবি বিদ্যাপতি –র উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও “ক্ষণদাগীতচিন্তামনি”, “পদামৃতসমুদ্র”, “পদকল্পতরু” প্রভৃতি পদ সংগ্রহ গ্রন্থে বিদ্যাপতি –র বহু পদ ঠাঁই পেয়েছে।

  • ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্যাপতি –র জীবন নিয়ে পরিচালক দেবকী বসু “বিদ্যাপতি” নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মান করেন এবং এই চলচ্চিত্রে বিদ্যাপতি চরিত্রে অভিনয় করেন পাহাড়ী সান্যাল

  • দেব সিংহের অনুরোধে কবি বিদ্যাপতি কাব্য রচনা শুরু করেন।

  • শিবসিংহ –এর রাজ সভায় থাকাকালীন বিদ্যাপতি তাঁর অধিকাংশ পদাবলী রচনা করেন।

  • বিদ্যাপতি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন জয়দেব –এর “গীতগোবিন্দ” কাব্যের দ্বারা। “গীতগোবিন্দ” কাব্যের ভাষা, ভাব, ছন্দ বিদ্যাপতি তাঁর পদগুলিতে যেমন আত্মীকরণ করেছেন ঠিক তেমনি তাঁর পদে সুললিত পদমাধুর্য এবং ধ্বনি ঝংকারও শোনা যায় তাঁর পদগুলিতে। তাই কবি বিদ্যাপতি কে ‘অভিনব জয়দেব’ আখ্যায় ভূষিত করা হয়।



বিদ্যাপতি রচিত গ্রন্থসমূহ :

১। ভূ – পরিক্রমা

২। কীর্তিলতা

৩। কীর্তিপতাকা

৪। পুরুষ পরীক্ষা

৫। দানবাক্যাবলী

৬। বিভাগসার

৭। লিখনবলী

৮। শৈবসর্বস্বহার

৯। গঙ্গাবাক্যাবলী

১০। দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী

 


পৃষ্ঠপোষক রাজা ও তাঁদের রাজত্বকালে লিখিত রচনা :

১) দেবসিংহ – “ভূ-পরিক্রমা” (১৪০০ সালের কাছাকাছি) – তীর্থ কাহিনীর আদলে লেখা ভৌগোলিক বিবরণ। সংস্কৃত ভাষায় লেখা।

২) কীর্তিসিংহ – “কীর্তিলতা” (১৪০২-০৪)। অবহটঠ ভাষায় লেখা। চম্পু জাতীয় কাব্য (গদ্য ও পদ্য মিশ্রিত)। এই গ্রন্থে কবি নিজেকে 'খেলন কবি' বলেছেন।

৩) শিবসিংহ – “কীর্তিপতাকা” (১৪১০) অবহটঠ ভাষায় তুর্কী অত্যাচারের কাহিনী। প্রশস্তিমূলক রচনা।

পুরুষ পরীক্ষা” – (১৪১৪) কথাসাহিত্যের রূপে রচিত।

৪) পুরাদিত্য – “লিখনাবলী” (১৪১৮) সংস্কৃত আলংকারিক বিষয়ক গ্রন্থ।

৫) ভৈরব সিংহ – “দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী” (১৪৪০-৬০) দুর্গাপূজার পদ্ধতি ও স্মৃতি শাস্ত্র বিষয়ক বিচার গ্রন্থ।

৬) নরসিংহ ও ধীরমতি দেবী – “দান বাক্যাবলী” (১৪৪০-৬০)।

৭) পদ্মিনী ও বিশ্বাস দেবী – “শৈবসর্বস্বহার” (১৪৩০-৪০)।


  • বিদ্যাপতি –র সংস্কৃত ভাষায় লেখা ২ টি নাটক  “গোরক্ষবিজয়” এবং “মণিমঞ্জরী”

  • বিদ্যাপতি –র রচিত হর – পার্বতী বিষয়ক পদগুলি “মহেশবাণী” নামে প্রচারিত ছিল।

  • কবি বিদ্যাপতি –র লেখা মনসামঙ্গল কাব্যের নাম – “ব্যাড়িভক্তিতরঙ্গিনী”

  • একমাত্র বিদ্যাপতি –ই রাধা –র অখণ্ড জীবন প্রবাহ কে বর্ণাড্য কল্পনার আলোকসম্পাতে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।

  • বিদ্যাপতি রচিত “পুরুষপরীক্ষা” –র ভূমিকা অংশে কবি সম্পর্কে জর্জ গ্রীয়ার্সন লিখেছেন –

Bidyapati flourished and was a celebrated author during at least the frist half of the 15th century”.

  • বিদ্যাপতি তাঁর পদগুলি মৈথিলী ভাষায় রচনা করেছিলেন। পরে তাঁর পদগুলি বাংলা, অসম, ওড়িশা, নেপাল প্রভৃতি অঞ্চলে প্রসারিত হলে এই ভাষায় নানান স্থানীয় ভাষা প্রবেশ করার ফলে এই মৈথিলী ভাষা কে কেন্দ্র করে ব্রজবুলি নামক মিশ্র ভাষার সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ব্রজবুলি ভাষায় তাঁর “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী” রচনা করেন।

  • কবি বিদ্যাপতি –র রচিত পদগুলি বাংলাদেশে পঞ্চদশ শতক থেকে জনপ্রিয় হতে শুরু করে।

  • বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রথম বিদ্যাপতি –র পদ সংকলন গ্রন্থ জগবন্ধু ভদ্র –এর “মহাজন পদাবলী” (১৮৭৪)।

  • কবি বিদ্যাপতি –র ভণিতায় প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথির ভিত্তিতে সবচেয়ে প্রামাণ্য সংকলন “বিদ্যাপতির পদাবলী” ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেন খগেন্দ্রনাথ মিত্র এবং বিমান বিহারী মজুমদার। এই সংকলনে বিদ্যাপতি রচিত ৯৩৩ টি পদ রয়েছে।




  • বিদ্যাপতির পদে উল্লিখিত মুসলমান রাজার নাম নুসরত শাহ

  • ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় –এর “বিদ্যাপতি” প্রবন্ধ টি বাংলা সাহিত্যে প্রথম গবেষণামূলক প্রবন্ধ। এবং এই প্রবন্ধে রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রথম প্রমাণ করেন “বিদ্যাপতি বাঙালী কবি নন”

  • বিদ্যাপতি অবহট্ট ভাষায় – “কীর্তিলতা” এবং “কীর্তিপতাকা” গ্রন্থ দুটি রচনা করেন, বৈষ্ণব পদগুলি রচনা করেন মৈথিলী ভাষায়।

  • বিদ্যাপতি রচিত সংস্কৃতে স্মৃতিশাস্ত্র বিষয়ক ২ টি গ্রন্থ – “বিভাগসার” এবং “দানবাক্যাবলী”

  • জগবন্ধু ভদ্র ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাপতির পদাবলী সংকলন "মহাজন পদাবলী" প্রকাশ করেন।

  • ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সারদাচরণ মিত্র বিদ্যাপতির পদাবলী প্রকাশ করেন ।

 

“ভূপরিক্রমা” 

১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন।

এটি ভূগোল বিষয়ক বই।

কবি তাঁর সময়কালের ভৌগলিক পরিচিতি এবং নানান তীর্থ স্থানের বর্ণনা দিয়েছেন।

 

“কীর্তিলতা” 

অবহট্ট ভাষায় রচিত।

এই গ্রন্থে কবি নিজেকে ‘খেলন কবি বা খেলুড়ে কবি’ বলেছেন।

গ্রন্থ টি ১৪০২ থেকে ১৪০৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত।

গ্রন্থ টি রচনাকালে কবির বয়স ২২ থেকে ২৪ বছর।

এই গ্রন্থে রাজা কীর্তিসিংহ –এর বীরত্বের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

 

“কীর্তিপতাকা” 

রাজা শিবসিংহ –এর রাজৈশ্বর্য এবং ব্যক্তি জীবন তথা প্রণয় জীবন কে কেন্দ্র করে রচনা করেন।

 


“পুরুষপরীক্ষা” 

১৪১০ থেকে ১৪১৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে গ্রন্থ টি রচনা করেন।

শিবসিংহ –এর রাজত্ব কালে এই গ্রন্থ টি কবি রচনা করেন।

গ্রন্থ টি সংস্কৃত ভাষায় রচিত।

 

“লিখনাবলী” 

১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন।

সংস্কৃত পত্র লেখার নিয়ম রীতি, অলংকার শাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ এটি।

 

“শৈবসর্বস্বসার” 

এটি উপসনা বিষয়ক গ্রন্থ।

 

“দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী” 

দুর্গা পূজা পদ্ধতি বিষয়ক গ্রন্থ এটি।

এই গ্রন্থে ১০০০ এরও বেশি শ্লোক রয়েছে।

 

“বিদ্যাপতি সুখের কবি"।

এবং বিদ্যাপতি –র চিত্রিত রাধা সম্পর্কে বলেছেন-

“বিদ্যাপতির রাধা নবীনা, নবস্ফুটা"।



"বিদ্যাপতি ভক্ত নহেন,কবি - গোবিন্দ দাস যত বড় কবি ততোধিক ভক্ত"।

"বিদ্যাপতি সুখের কবি"।

“দূরগামিনী বেগবতী তরঙ্গসঙ্কুলা নদী"।

"বিদ্যাপতির কবিতা স্বর্ণহার এবং চন্ডীদাসের কবিতা রুদ্রাক্ষমালা"।

  • বিদ্যাপতি –র পদ বিশ্লেষণ করে সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাপতি কে “Cosmic Imagination” –এর অধিকারী বলেছেন।

  • আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর “বঙ্গভাষা ও সাহিত্য” গ্রন্থে বিদ্যাপতি সম্পর্কে বলেছেন –

“বাঙালী বিদ্যাপতির পাগড়ী খুলিয়া লইয়া ধুতি চাদর পড়াইয়া দিয়াছে"।

  • অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাপতি সম্পর্কে বলেছেন -

"বিদ্যাপতি বাইরের কবি"।


বিদ্যাপতি রচিত উল্লেখযোগ্য পদ :

  • "হাথক দরপণ মাথক ফুল" - পূর্বরাগ-অনুরাগ।

  • "এ সখি হামারি দুখক নাহি ওর" - মাথুর।

  • "অব মথুরাপুর মাধব গেল" - মাথুর।

  • "অঙ্কুর তপন তাপে যদি জারব" - মাথুর।

  • "আজু রজনী হাম" - ভাবোল্লাস ও মিলন।

  • "মাধব বহুত মিনতি করি তোয়" - প্রার্থনা।

  • "তাতল সৈকত বারিবিন্দু সম" – প্রার্থনা।

বিদ্যাপতিকে নিয়ে লেখা গ্রন্থ :

১। “বিদ্যাপতি ও জয়দেব” (প্রবন্ধ) - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

২। “চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি” (প্রবন্ধ) - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 ৩। “বিদ্যাপতি গোষ্ঠী” - সুকুমার সেন।

৪। “বিদ্যাপতি বিচার” - সতীশচন্দ্র রায়।

৫। “কবি বিদ্যাপতি” - তারাপদ মুখোপাধ্যায়। 


আরও পড়ুন - 

উৎপল দত্ত : "ফেরারী ফৌজ" -এর রচয়িতা

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় : “পথের পাঁচালী” -র রচয়িতা

আশাপূর্ণা দেবী (গুপ্ত) : শ্রেষ্ঠ ট্রিলজি রচয়িতা

নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ

বুদ্ধদেব বসু : “যৌবন বসন্তের কবি”

সৈয়দ মুজতবা আলী  : “দেশে-বিদেশে”-র রচয়িতা

নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র

কাজী নজরুল ইসলাম : রবীন্দ্রনাথের পর ‘প্রথম মৌলিক কবি’

বাংলা সাহিত্যে অপ্রধান মঙ্গলকাব্য ও কবি

কিছু বাংলা গ্রন্থের পূর্বনাম

Post a Comment

0 Comments