ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সৃষ্টির আগে বাংলা গদ্য রচনার যে সকল নিদর্শন পাওয়া যায় সেই সকল গদ্য রচনায় যথেষ্ট শৃঙ্খলার অভাব লক্ষ করা যায়। সেই অভাব দূরের জন্য কলকাতার লালবাজারের কাছে লর্ড ওয়েলেসলির প্রচেষ্টায় ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
কলেজের প্রথম অধ্যাপক হন – ডেভিড ব্রাউন।
কলেজ প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বেশি উন্নতি লাভ করে বাংলা গদ্য রচনায়। আর এই উন্নতির প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন উইলিয়াম কেরি। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগদান করেন। পরে তিনি মারাঠী বিভাগের অধ্যাপক অধ্যক্ষ হন।
কলেজ থেকে প্রকাশিত প্রথম গদ্যগ্রন্থ – রামরাম বসুর “রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র” (১৮০১)।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় : রাঢ় বাংলার রূপকার |
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান লেখকবৃন্দ :
রামরাম বসু :
অষ্টাদশ শতকে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় জন্মগ্রহন করেন। তিনি বাংলা, সংস্কৃত ও ফার্সী ভাষায় দক্ষ ছিলেন। প্রথম দিকে তিনি ভারতে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচারে আসা মিসনারি পার্দীদের বাংলা শেখাতেন। পরে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম কেরি ভারতে এলে রামরাম বসু তাঁর মুন্সি হিসেবে নিযুক্ত হন এবং তাঁর বাংলা শিক্ষকও ছিলেন।
১৮০১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ঠা মে রামরাম বসু মাসিক ৪০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রূপে নিযুক্ত হন।
রামরাম বসু রচিত “রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র” (১৮০১) বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা মৌলিক গদ্যগ্রন্থ ও ছাপাখানায় মুদ্রিত প্রথম বই।
তাঁর রচিত গ্রন্থ –
১। “রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র” (১৮০১) – প্রথম জীবনী সাহিত্য। ফার্সি উপাদান থেকে নানান উপাদান সংগ্রহ করে রামরাম বসু এই গ্রন্থ টি রচনা করেন।
২। “লিপিমালা” (১৮০২) – পত্রসংকলন, ১৮০২ সালে এটি শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হয়।
কামিনী রায় : দেশের প্রথম মহিলা স্নাতক |
উইলিয়াম কেরী :
ভারতবর্ষের মানুষকে যে ক’জন বিদেশি প্রগতি ও উন্নয়নের পথ দেখিয়েছিলেন উইলিয়াম কেরি তাদের অন্যতম। ১৭৬১ সালের ১৭ আগস্ট কেরি ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনশায়ারের পলার্সপুরি নামক এক গ্রামের চার্চের পাদরি এডমন্ড ও তাঁর স্ত্রী এলিজাবেথ কেরির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৭৯৩ সালের ১৩ জুন স্বদেশ ত্যাগ করে তিনি সপরিবারে ওই বছরের ১১ নভেম্বর কলকাতায় পৌঁছান।
তিনি বাঙালি পণ্ডিত রামরাম বসুর নিকট বাংলা শিখতে শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে বাংলা ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। একই সঙ্গে তিনি রামরাম বসুকে মুন্সি নিয়োগ করে তার সহায়তায় বাইবেলকে বাংলায় অনুবাদের কাজ শুরু করেন।
এদেশীয় ইংরেজ কর্মচারীদের সুবিধার্থে তিনি বাংলা ভাষায় একটি শব্দকোষ প্রণয়ন করেন। ১৮০০ সালে তার প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই মিশনে একটি প্রেস স্থাপন করা হয়। উইলিয়াম কেরি পঞ্চানন কর্মকারের সহায়তায় বাইবেলের অংশ বিশেষ বাংলায় অনুবাদ ও মুদ্রণ করেন।
১৮০১ সালের মে মাসে উইলিয়াম কেরি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা, সংস্কৃত ও মারাঠি ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এখানে ভাষা শিক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি ভারতীয় ভাষাগুলো, বিশেষ করে বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ উন্নতিসাধনে আত্মনিয়োগ করেন।
১৮০৬ সালে কেরি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হন।
১৮০৭ সালে আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডক্টর অফ ডিভিনিটি’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৮২৩ সালে ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম এগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থ –
১। A Grammar of Bengali Language (1801)
২। “কথোপকথন” (১৮০২) – কথ্য ভাষার রূপ লক্ষণীয়। সমগ্র গ্রন্থটির পরিকল্পনা ছিল তাঁরই। কলকাতার মৌখিক ভাষার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।
৩। “ইতিহাসমালা” (১৮১২) – ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ।
৪। “বাংলা-ইংরেজি অভিধান” (১৮১৫-২৫)
৫। “ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ধর্মপুস্তক” (চার খণ্ডে বিভক্ত, ১৮০২-০৯, হিব্রু থেকে অনূদিত)
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার :
আনুমানিক ১৭৬২ – ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে চট্টোপাধ্যায় উপাধিক ব্রাহ্মণ মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার মেদনীপুরে (মতান্তরে উড়িষ্যার ভদ্রেক, তখন তা মেদনীপুরের অন্তর্গত ছিল) জন্মগ্রহন করেন।
১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে মাসিক ২০০ টাকা বেতনে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলার প্রধান পণ্ডিত হিসেবে নিযুক্ত হন।
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ছিলেন এই কলেজের লেখক গোষ্ঠীর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।
তাঁর “প্রবোধচন্দ্রিকা” (১৮৩৩) ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, হিন্দু কলেজ, হুগলি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল।
অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন –
“মৃত্যুঞ্জয় ছিলেন বাঙলা গদ্যের প্রসূতি গৃহের ধাত্রী মাতা।"
তাঁর রচিত গ্রন্থ –
১। “বত্রিশ সিংহাসন” (১৮০১) – অনুবাদমূলক রচনা, সংস্কৃত কাহিনির রূপান্তর। উইলিয়াম কেরির নির্দেশে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার “সিংহাসনদ্বাত্রিংশিকা” অবলম্বনে এটি রচনা করেন। আদর্শ রাজা বিক্রমাদিত্যের চরিত কথা, ঔদার্য ও মহানুভবতা বর্ণনা এই বত্রিশ টি গল্পের উদ্দেশ্য।
২। “রাজাবলি” (১৮০৮) – ইতিহাস বিষয়ক মৌলিক রচনা। বাঙালির লেখা প্রথম ইতিহাসমূলক রচনা। হিন্দু যুফ, মুসলমান শাসক ও ইংরেজ আমলের ইতিহাস অবলম্বনে রচিত। এই রচনা সম্পর্কে সজনীকান্ত দাস যথার্থই বলেছেন –
“বাংলা ভাষার ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম ধারাবাহিক ইতিহাস তাহাতে সন্দেহ নেই” (বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস)।
৩। “হিতোপদেশ” (১৮০৮) – অনুবাদমূলক রচনা, সংস্কৃত কাহিনির রূপান্তর।
৪। “বেদান্তচন্দ্রিকা” (১৮১৭) – এটি মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের স্বাধীন রচনা। “বেদান্তচন্দ্রিকা” তিন ভাগে বিভক্ত – কর্ম কাণ্ড, উপাসনা কাণ্ড ও জ্ঞান কাণ্ড। এই গ্রন্থের মূল উদ্দেশ্য ছিল বেদান্ত শাস্ত্রের প্রকৃত তাৎপর্য ব্যাখ্যা।
৫। “প্রবোধচন্দ্রিকা” (১৮৩৩) – তত্ত্ব ও ন্যায় দর্শন বিষয়ক মৌলিক রচনা, সংকলন গ্রন্থ। তাঁর মৃত্যুর পর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
জন ক্লার্ক মার্শম্যান ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত “প্রবোধচন্দ্রিকা” –র প্রথম সংস্করণে গ্রন্থের গুনাগুন সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত –
“Any person who can comprehend the present work, and enter into the spirit of beauties, may justly consider himself master of the language”.
বাংলা সাহিত্যে নিষিদ্ধ এবং মঞ্চায়নে আপত্তিজনক নাটক |
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গৌণ লেখকবৃন্দ :
গোলকনাথ শর্মা :
ইনি ছিলেন মূলত অনুবাদক। “হিতোপদেশ” –এর চারটি উপদেশই – মিত্রলাভ, মিত্রভেদ, সন্ধি ও বিগ্রহ তিনি সংক্ষেপে অনুবাদ করেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থ –
১। “হিতোপদেশ” (১৮০২) – অনুবাদমূলক রচনা।
তারিণীচরণ মিত্র :
তারিণীচরণ মিত্র ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হিন্দি বিভাগের মুন্সি। তিনি ঈশপের গল্পের অনুবাদক এবং ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ –র পাঠ্য গ্রন্থের লেখক রুপে বেশি পরিচিত ছিলেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থ –
১। “ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট” (১৮০৩) – রোমক হরফে ভারতীয় ছয় টি ভাষায় অনুবাদ গ্রন্থ।
২। “নীতিকথা” (১৮১৮)
চণ্ডীচরণ মুন্সি :
১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগদান করেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থ –
১। “তোতা হতিহাস” (১৮০৫) – ফার্সি “তুতিনামা” –র বাংলা অনুবাদ। এমনকি লণ্ডন থেকেও এই গ্রন্থের সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আলিফ – লায়লার অনুকরণে গ্রন্থ টি রচিত।
বিদ্যাপতি : বৈষ্ণব পদাবলীর আদি কবি |
রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় :
১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগে সহকারী পণ্ডিত রুপে যোগদান করেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থ –
১। “মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং” (১৮০৫) – অনুবাদমূলক রচনা।
হরপ্রসাদ রায় :
তাঁর রচিত গ্রন্থ –
১। “পুরুষ পরীক্ষা” (১৮১৫) - অনুবাদমূলক রচনা। উইলিয়াম কেরির নির্দেশে বিদ্যাপতি রচিত সংস্কৃত “পুরুষপরীক্ষা” –র অনুবাদ করেন।
কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন :
১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী পণ্ডিত ছিলেন।
তাঁর রচিত গ্রন্থ –
১। “পদার্থকৌমুদী” (১৮২১)
২। “আত্মততত্ত্বকৌমুদী” (১৮২২)
৩। “পাষণ্ড পীড়ন” (১৮২৩) – রাজা রামমোহনের বিরুদ্ধে বাদ – প্রতিবাদের উত্তর।
৪। “সাধুসন্তোষিণী” (১৮২৬)
৫। “শ্যামাসন্তোষিণী” (১৮৩৪ – ৪৫)
বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সময়িক পত্র |
- বাংলা গদ্যের উদ্ভবপর্বে গদ্য রচনার পথ কে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠী যেভাবে সুগম করেছিল তার অবদান বাংলা গদ্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
0 Comments