উনিশ শতকের বাংলা নাটকে বিধবা বিবাহ প্রসঙ্গ:
উনিশ শতকে বাংলা সমাজে চলে আসা বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও কৌলীন্য প্রথার অবশ্যম্ভাবী
পরিণতি হিসেবে দেখা দেয় অকাল বৈধব্য যন্ত্রনা। সমাজে বিধবা নারীর সংখ্যাধিক প্রভূত
পরিমাণ হয়েছিল। সমাজে দেখা দিয়েছিল নারী প্রণয় ঘটিত নানা ব্যাভিচার। সমাজ পৌঁছেছিল
কলুষতার তীব্রতায়। গ্রামের বঞ্চিত যুবতীরা জীবন বাঁচানোর তাগিদে গড়ে ওঠা নতুন শহর কলকাতার
রাজপথে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল। বাধ্য হয়েছিল নব্য রক্ষিতা হয়ে জীবন কাটাতে।এই সমাজ সংকটে
খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল বিধবাদের পুনর্বিবাহ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা এই নারীদের অসহয়তা কে দরদ দিয়ে উপলব্ধি
করলেন এবং এর থেকে মুক্তির উপায় খোঁজার চেষ্টা করলেন। তবে বিধবা বিবাহ আমাদের সমাজে
অসঙ্গত আচরণ বলে গৃহীত হয়েছে। বিধবা বিবাহ কে কেন্দ্র করে তৈরি হয় নানান প্রবাদ। তার
মধ্যে খুব প্রচলিত একটি প্রবাদ ছিল -
“রাঁড়ী বেটীর
বিয়ের সখ
উনায় রসের কত
ঠমক”।
নারীদের মুক্তির উদ্দেশ্যে ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে নানান বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উদ্যোগে বিধবা বিবাহ আইন হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তীকালে বিধবাদের পুনর্বিবাহের বিষয় টি সবচেয়ে প্রভাব
বিস্তার করে বাংলা নাট্য সাহিত্যে। বিধবা বিবাহের পক্ষে বিপক্ষে লেখা হয় একাধিক নাটক।
উনিশ শতকের বাংলা নাটকের ইতিহাস লক্ষ করলে দেখা যাবে, বাংলা সামাজিক নাটকের কাহিনিবৃত্তে
বিষয় হিসেবে ঘুরে ফিরে এসেছে বিধবার পুনর্বিবাহ প্রসঙ্গ। কখনও সহানুভূতিতে, কখনও উপহাসে
– বিদ্রুপে, কখনও মুখরোচক ব্যাঙ্গের ঝলকানিতে। বিধবা বিবাহের মত গভীর ও গম্ভীর বিষয়কে
কৌতুক রসের অবতারণা করে হাস্যরসের খোরাক করা হয়ঠেছে,যে সকল নাটকগুলিতে বিধবা বিবাহ
প্রসঙ্গ ফুটে উঠেছে, নিম্নে তালিকাকারে নাট্যকারের নাম সহযোগে নাটকগুলির নামোল্লেখ
করা হল –
নাট্যকার – রচিত নাটক
১। রামনারায়ণ তর্করত্ন – কুলীন কুলসর্ব্বস্ব (১৮৫৪)
২। উমেশচন্দ্র মিত্র – বিধবা বিবাহ নাটক (১৮৫৬)
৩। উমাচরণ চট্টোপাধ্যায় – বিধবোদ্বাহ (১৮৫৬)
৪। রাধামাধব মিত্র – বিধবা মনোরঞ্জন (১৮৫৬)
৫। যদুগোপাল চট্টোপাধ্যায় – চপলা চিত্তচাপল্য (১৮৫৭)
৬। বিহারীলাল নন্দী – বিধবা পরিনয়োৎসব (১৮৫৭)
৭। গুণাভিরাম শর্মা – রামনবমী (১৮৫৭)
৮। গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন – বিধবা বিবাহ বিষম দায় (১৮৫৮)
নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত বিভিন্ন রচনা |
৯। তারকচন্দ্র চূড়ামণি – সপত্নী নাটক (১৮৫৮)
১০। নারায়ণ চট্টরাজ গুণনিধি – কলি – কৌতুক (১৮৫৮)
১১। মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় – চার ইয়ারের তীর্থযাত্রা (১৮৫৮)
১২। শ্যামাচরণ দে – বাসরকৌতুক (১৮৫৯)
১৩। দীনবন্ধু মিত্র – নীলদর্পণ (১৮৬০)
১৪। শ্রীশিমূয়েল পিরবক্স – বিধবা বিরহ নাটক (১৮৬০)
১৫। শ্যামাচরণ শ্রীমানি – বাল্যোদ্বাহ (১৮৬০)
১৬। প্রসন্নকুমার পাল – বেশ্যাসক্তি নিবর্ত্তক (১৮৬০)
১৭। মাইকেল মধুসূদন দত্ত – একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০)
১৮। মাইকেল মধুসূদন দত্ত – বুড়ো শালিকের ঘারে রোঁ (১৮৬০)
১৯। যদুনাথ চৌধুরী – লম্পট চৈতন্যদয় (১৮৬১)
২০। অম্বিকাচরণ বসু – কুলীন কায়স্থ (১৮৬১)
বাংলা সাহিত্যে এলিজি বা শোকপ্রকাশক কবিতা |
২১। হারাণচন্দ্র (শর্ম্মা) মুখোপাধ্যায় – দলভঞ্জন নাটক (১৮৬১)
২২। হরিশ্চন্দ্র মিত্র – শুভ্রস্র শীঘ্রং (১৮৬১)
২৩। হরিশ্চন্দ্র মিত্র – ম্যাও ধরবে কে? (১৮৬২)
২৪। কুশদেব পাল – আইন সংযুক্ত কাদম্বিনী নাটক (১৮৬২, ২ খণ্ড)
২৫। গৌরমোহন বসাক – অশুভ পরিহারক (১৮৬২)
২৬। গুরুপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় – পুনর্ব্বিবাহ (১৮৬২)
২৭। ভুবনেশ্বর মুখোপাধ্যায় – গুলি হাড়কালি (১৮৬২)
২৮। হরিশ্চন্দ্র বসাক – শ্যামকিশোরী (১৮৬২)
২৯। ভুবন মোহন চক্রবর্তী – শ্রেয়াংসি বহু বিঘ্নানি (১৮৬২)
৩০। রামনাথ ঘোষ – পাড়া গাঞ্যে একি দায়? (১৮৬২)
৩১। দীনবন্ধু মিত্র – নবীন তপস্বিনী (১৮৬৩)
৩২। গোবিন্দচন্দ্র চক্রবর্তী – অশুভস্য কালহরং (১৮৬৩)
বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যিকদের রচিত শ্রেষ্ঠ রচনা |
৩৩। রামকৃষ্ণ সেন – হুড়কো বৌয়ের বিষম জালা (১৮৬৩)
৩৪। কালাচাঁদ শর্মা ও বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় – একেই বলে বাবুগিরি (১৮৬৩)
৩৫। ব্রজমাধব শীল – পরের ধনে বরের বাপ (১৮৬৩)
৩৬। নফরচন্দ্র পাল – কন্যা বিক্রয় (১৮৬৩)
৩৭। ভোলানাথ মুখোপাধ্যায় – কনের মা কাঁদে আর টাকার পুঁটলি বাঁধে (১৮৬৩)
৩৮। প্রাণনাথ দত্ত – প্রাণেশ্বর (১৮৬৩)
৩৯। দুর্গাদাস কর – স্বর্ণশৃঙ্খল (১৮৬৩)
৪০। ব্যোমকেশ বাঙ্গাল – ঘর থাকতে বাবুই ভেজে (১৮৬৩)
৪১। মুনশী নামদার – কাশীতে হয় ভূমিকম্প নারীদের একি দম্ভ (১৮৬৩)
৪২। রাধামাধব হালদার – বেশ্যানুরক্তি বিষম বিপত্তি (১৮৬৩)
৪৩। যদুনাথ চট্টোপাধ্যায় – বিধবা বিলাস (১৮৬৪)
৪৪। দ্বারকানাথ মিত্র – মুষলং কুলনাশনং (১৮৬৪)
বাংলা সাহিত্যে আত্মজীবনীমূলক রচনা |
৪৫। হরিমোহন কর্মকার – ওঠ ছুঁড়ি তোর বে (১৮৬৪)
৪৬। বিশ্বম্ভর দত্ত – চোর বিদ্যা বড় বিদ্যা (১৮৬৪)
৪৭। রামনারায়ণ তর্করত্ন – যেমন কর্ম তেমনি ফল (১৮৬৫)
৪৮। রামনারায়ণ তর্করত্ন – নবনাটক (১৮৬৬)
৪৯। দীনবন্ধু মিত্র – সধবার একাদশী (১৮৬৬)
৫০। দীনবন্ধু মিত্র – বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬)
৫১। নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় – বুঝলে কিনা (১৮৬৬)
৫২। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় – মেঘনাদবধ নাটক (১৮৬৭)
৫৩। হারাণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় – বঙ্গকামিনী (১৮৬৮)
৫৪। বিপিনমোহন সেনগুপ্ত – হিন্দু মহিলা (১৮৬৮)
বাংলা সাহিত্যে ত্রয়ী বা ট্রিলজি |
৫৫। উপেন্দ্রনাথ দাস – শরৎ সরোজিনী ৯১৮৭৪)
৫৬। গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায় – বিধবার দাঁতে মিশি (১৮৭৪)
৫৭। জনৈক ভদ্রমহিলা – সন্তাপিনী (১৮৭৬)
৫৮। রাধারমণ কর – সরোজা (১৮৭৭)
৫৯। নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্য – বিধবা (১৮৭৭)
৬০। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর – এমন কর্ম আর করব না (১৮৭৭)
৬১। বিরাজমোহন চৌধুরী – বঙ্গবিধবা (১৮৮২)
৬২। অমৃতলাল বসু – তরুবালা (১৮৯০)
৬৩। অমৃতলাল বসু – বিলাপ (১৮৯১)
৬৪। অতুলকৃষ্ণ মিত্র – বিধবা কলেজ (১৮৯২)
৬৫। অমৃতলাল বসু – বাবু (১৮৯৪)।
আরও পড়ুন -
0 Comments