Subscribe Us

চর্যাপদ : বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন

চর্যাপদ




লৌকিক নাম – চর্যাপদ।

প্রকৃত নাম – “চর্যাগীতিকোষবৃত্তি”। নাম টি প্রবোধ চন্দ্র বাগচী আবিষ্কৃত কীর্তিচন্দ্র রচিত তিব্বতী অনুবাদ থেকে জানা যায়।

আবিষ্কারক – মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে (১৩১৪ বঙ্গাব্দ) তৃতীয় বারের জন্য নেপাল যাত্রা করলে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে আরও তিন টি পুঁথিসহ চর্যাপদ্গুলি আবিষ্কার করেন। তিনি চর্যাপদের নাম পরিবর্তন করে রাখেন – “চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়”।

চর্যাপদ ছাড়া অনান্য পুঁথিগুলি হল –

১। সরহপাদ –এর “দোহাকোষ”

২। কাহ্নপাদ –এর “দোহাকোষ”

“ডাকার্ণব”।


প্রকাশ – হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে তিন টি পুঁথি ও চর্যাপদগুলি একত্রিত করে “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা” নাম দিয়ে প্রকাশ করেন।

রচনাকাল – চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে সমালচকেদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বলা যায় চর্যাপদের রচনাকাল দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী।

ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় –এর মতে দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগের মধ্যে চর্যাগানগুলি রচিত হয়েছিল।

সুকুমার সেন - ১০ম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী।

সুখময় মুখোপাধ্যায় - অষ্টম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী।

প্রবোধ চন্দ্র বাগচী - দশম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী।

রাহুল সংকৃত্যায়ন - অষ্টম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সপ্তম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী।

রাহুল সাংকৃত্যায়ন এবং ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় –এর উল্লিখিত রচনাকাল কে আরও ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে চর্যার রচনাকাল খ্রিষ্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মতপ্রকাশ করেন।



চর্যাপদের ভাষা – চর্যাপদগুলি প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত, কিন্তু পদগুলির বোধগম্যতার অভাবে অনেকের মতে এই ভাষার নাম ‘সান্ধ্যভাষা’

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে চর্যাপদের ভাষা - 'বঙ্গ কামরূপী'

অবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের ভাষা বিচার করে জানিয়েছেন –

“আমার বিশ্বাস, যাঁরা এই ভাষা লিখিয়াছেন, তাঁরা বাঙ্গালী ও তন্নিকটবর্তীদেশের লোক। অনেকে যে বাঙ্গালী ছিলেন, তাহার প্রমাণও পাওয়া গিয়াছে। যদিও অনেকের ভাষায় একটু একটু ব্যাকরণের প্রভেদ আছে, তথাপি সমস্তই বাঙ্গালা বলিয়া বোধ হয়"।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাগীতি ও দোহাকোষের ভাষাতত্ত্ব আলোচনা করে তাঁর “The Origin and Devlopment of Bengali Language” (১৯২৬) গ্রন্থে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতকেই প্রতিষ্ঠা করে বলেছেন পদসংকলন টি আদিতম বাংলা ভাষায় রচিত।

 

চর্যাপদের বিভিন্ন নামকরণ :

 

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়

 

প্রবোধচন্দ্র বাগচী

চর্য্যাগীতিকোষ

 

সুকুমার সেন

চর্য্যাগীতিপদাবলী

 

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

চর্য্যাগীতিকা

 

নীলরতন সেন

চর্য্যাগীতিকোষ

 

শশীভূষণ দাশগুপ্ত

চর্য্যাগীতি

 


  • হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় আবিষ্কৃত পুঁথি টি তালপাতার উপর রচিত।

  • চর্যার কবিরা ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়া সাধক বা সিদ্ধাচার্য।

  • হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় মোট সাড়ে ৪৬ টি পদ আবিষ্কার করেন। কিন্তু মূল গ্রন্থে পদের সংখ্যা ৫০ টি (মতান্তরে ৫১ টি)।

২৪, ২৫ ও ৪৮ নং পদ সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত এবং ২৩ নং পদের অর্ধেক অংশ ৬ টি চরণ পাওয়া যায়, শেষাংশ নষ্ট হয়ে যায়।

২৪, ২৫ ও ৪৮ নং পদ সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হলেও চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদে এই ৩ টি পদ পাওয়া যায়। এই তিনি টি পদের পদকর্তা যথাক্রমে – কাহ্নপাদ, তান্তীপাদ এবং কুক্করীপাদ

নষ্ট হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলি বাদ দিলে পুঁথির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৪ টিশেষ পাতার পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৯

৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৯ আনং ৬৬ সংখ্যক পুঁথির মোট ৫ টি পাতা নষ্ট হয়ে যায়।

  • পুঁথিটি শুরু হয়েছে “নমঃ শ্রীবজ্রযোগিনৈ” শব্দ দিয়ে।

  • মোট ২৪ জন পদকর্তার নাম পাওয়া যায় (মতান্তরে ২৩ জন)। কোন কোন সমালোচকের মতে মোট ২২ জন কবির পদ ছিল।

  • চর্যাপদ –এর প্রথম পদ টি রচনা করেন – লুইপাদ। চর্যাপদ –এর টীকাকার মুনিদত্ত লুইপাদ কে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন।

  • চর্যাপদে ব্যবহৃত রাগের সংখ্যা ২২ টি।

'পটমঞ্জরী রাগে' সর্বাধিক (১১ টি) পদ রচিত হয়েছে।

চর্যাপদ –এর শেষ পদটিতে রামক্রী রাগের উল্লেখ রয়েছে।

চর্যাপদে পাদাকুলক ছন্দের সবচেয়ে (৩৬ বার) বেশি ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

চর্যাপদের ৫ টি পদের ভণিতায় কোন কবির নাম পাওয়া যায়নি।

  • চর্যার কবিতাগুলি সাধারণত ১০ লাইনে রচিত। কিন্তু ১ টি ৮ লাইন, ২ টি ১২ লাইন আনং ১ টি ১৪ লাইনের পদ রয়েছে।
  • চর্যাপদে টীকাসহ মোট শব্দ সংখ্যা ১৬৬০ টি।
  • চর্যাপদের টীকায় মুনিদত্ত লুইপাদ কে 'জ্ঞানানন্দসুন্দর' আখ্যা দিয়েছেন।
  • চর্যাপদের কবি ভুসুকুপাদ কে 'চিত্রধর্মী কবি' বলা হয়।
  • চর্যাগীতির ফটোকপি প্রকাশ করেন নীলরতন সেন
  • ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত চর্যাপদ বিষয়ক গ্রন্থের না - "Buddhist Mystic Songs".
  • ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ -এর মতে চর্যাপদের সর্বমোট পদকর্তা ২৩ জন।


পদকর্তাদের পদ সংখ্যা :

 

পদ কর্তা

পদ সংখ্যা

কাহ্নপা

১৩

ভুসুকপাদ

সরহপাদ

কুক্কুরীপাদ

লুইপাদ

শবরপাদ

শান্তিপাদ

চাটিলপাদ

ডোম্বীপাদ

 

  • চর্যাগীতির তিব্বতী টীকাকার কীর্তিচন্দ্র। তিব্বতী অনুবাদ টি আবিষ্কার করেন প্রবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয়।

  • চর্যাগীতির সংস্কৃত টীকাকার মুনিদত্ত
মুনি দত্ত সংস্কৃত ভাষায় ৫০ টি পদের টীকা রচনা করেন। তাঁর টীকার নাম "নির্মল গীরার" টীকা। তিনি লাড়ী ডোম্বীর পদের ১১ সংখ্যাক টীকাটি রচনা করেন নি।

 


  • চর্যাপদের আধুনিকতম পদকর্তা - সরহপা/ভুসুকপা

  • চর্যাপদের বাঙালী কবি - শবরপা

  • ভুসুকপা নিজেকে বাঙালী বলে পরিচয় দিয়েছেন।

  • চর্যাপদের একমাত্র মহিলা কবি - কুক্কুরীপা

  • চর্যাপদে নাম থাকলেও পদ পাওয়া যায়নি লাড়ীডোম্বী পা এর।


চর্যাপদের প্রবাদ বাক্য:

  • দুহিল দুধু কি বেন্টে সামায়।
  • হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।
  • আন চাহন্তে আন বিনধা।
  • হাতের কাঙ্কণ মা লোউ দাপন।
  • আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।


নব চর্যাপদ :

এটি চর্যাপদ সংকলন। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্ত ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে নেপালে গিয়ে ২০ টি প্রাচীন পুঁথি থেকে মোট ২৫০ টি চর্যাগীতি সংগ্রহ করেন। যা ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় –এর সম্পাদনায় ৯৮ টি পদ নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়।

এই পদগুলির মধ্যে ৪৪ টি পদ ত্রয়োদশ – চতুর্দশ শতাব্দী তে রচিত বলে অনুমেয়। যা উক্ত শতাব্দীর বন্ধ্যাত্বের অপবাদ দূর করে।

নেপালে নব চর্যাপদগুলি “চাচা সংগীত” নামে পরিচিত ছিল। সেই থেকে নব চর্যাপদগুলি কে বাংলা তেও “চাচা সংগীত” বলা হয়।

চর্যাপদ –এর ১৭ নং পদে ‘বুদ্ধ’ ‘নাটক’, ৩৯ নং পদে ‘বঙ্গ দেশ’ এবং ৪৯ নং পদে ‘বঙ্গাল দেশ’, ‘বাঙ্গালী জাতি’ –র উল্লেখ রয়েছে।


চর্যাপদের বিভিন্ন পদে যে বিষয় গুলির উল্লেখ রয়েছে :

  •  নং পদ – পিড়ির উল্লেখ রয়েছে।

  •  নং পদ চোরবৃত্তিতেঁতুলের উল্লেখ পাওয়া যায়।

  •  নং পদ – ঘটীশুণ্ডিনীদের পানীয় বিক্রির কথা উল্লিখি হয়েছে।

  •  নং পদ – হাতির কথা রয়েছে।

  • ১০ নং পদ - ডোমেদের নগরের বাইরে থাকার কথাডোমিনীদের চাঙারি তৈরীনটদের নটপেটিকা বহনের কথা উল্লিখিত হয়েছে।

  • ১১ নং পদ কাপালি যোগী উল্লেখ পাওয়া যায়।

  • ১২ নং পদ দাবা খেলার বর্ণনা রয়েছে।

  • ১৪ নং পদ - গঙ্গাযমুনানৌকা পারাপারের সময় কড়ি প্রদানের কথা এবং রথের উল্লেখ রয়েছ।

  • ১৬ নং পদ গঙ্গাযমুনার উল্লেখ পাওয়া যায়।

  • ১৭ নং পদ নাটকগানবাজনা এবং হাতির কথা বর্ণিত হয়েছে।

  • ১৮ নং পদ কুলীনদের কথাডোমিনীদের গণিকাবৃত্তির উল্লেখ পাওয়া যায়।

  • ২৩ নং পদ ব্যাধের শিকারের উল্লেখ রয়েছে।

  • ২৬ নং পদ তুলো ধুনার কথা উল্লিখিত হয়েছে।

  • ২৮ নং পদ তাম্বুলগুঞ্জার অলংকারউঁচু পর্বত।

  • ২৯ নং পদ আগমবেদ পাঠ ঘণ্টমালার উল্লেখ রয়েছে।

  • ৩৩ নং পদ – হাঁড়ি, ভাতদুধ।

  • ৩৮ নং পদ নৌবাহিনীর কথা পাওয়া যায়।

  • ৪৯ নং পদ পদ্মাকে খাল বলা হয়েছে।

  • ৫০ নং পদ - বাড়িকৃষি সভ্যতা।


চর্যাপদের রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:

১। কর্তৃকারক প্রায় বিভক্তি হীন।

২। করণ কারকে ‘এন’ জাত ‘এঁ’ বিভক্তি পাওয়া যায়।

৩। অধিকরণ কারকে ‘এ’ বিভক্তি ছাড়া ‘ই’, ‘ত’, ‘হি’ বিভক্তি লক্ষণীয়।

৪। গৌনকর্ম ও সম্প্রদানে ‘ক’ এবং ‘রে’ বিভক্তি লক্ষ্য করা যায়।

৫। অনেক ক্ষেত্রে ‘শ’ এর স্থানে ‘স’ ব্যবহৃত হয়েছে।

 

চর্যাপদের ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য:

১। শব্দের শেষে স্বরধ্বনি লুপ্ত হয়ে যায়নি।

২। দুই বর্ণের মধ্যবর্তী একক মহাপ্রাণ ধ্বনি অনেক সময় ‘হ’ ধ্বনি তে রুপান্তরিত হয়েছে।

৩। পাশাপাশি অবস্থিত স্বরধ্বনির মাঝে প্রায়ই শ্রুতিধ্বনির আগমন ঘটেছে।


চর্যাপদ থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্নোত্তর:

 

১) চর্যাপদ ভারতের বাইরে বা নেপালে পাওয়া যাবার কারণ কী?

উত্তর - চর্যাপদ ভারতের বাইরে বা নেপালে পাওয়া যাবার কারণগুলি হল ---

(ক) ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলার পাল বংশের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাদের আমলে চর্যাগীতির বিকাশ ঘটেছিল। পাল বংশের পরপরই বাংলাদেশে পৌরাণিক হিন্দুধর্ম ও ব্রাহ্মণ্যসংস্কার রাজধর্ম হিসেবে গৃহীত হয়। অপরদিকে, বাংলার সেন রাজারা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাই ধর্মীয় সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত সেন সময়কালের কতিপয় হিন্দু ব্রাহ্মণ বৌদ্ধদের ওপর নিপীড়ন চালায়। সেন রাজাদের প্রতাপের কারণেই বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে অর্থাৎ বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়েছিল।

(খ) আবার, ১২০৪ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলায় আগমন ঘটলে মুসলিম তুর্কিদের আক্রমণের ভয়ে বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ প্রাণের ভয়ে পুথিপত্র নিয়ে নেপাল, ভুটান ও তিব্বতে পালিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জীবনীকার সত্যজিৎ চৌধুরী লিখেছেন, --- "তুর্কি আক্রমণের সময়ে পুথিপত্র নিয়ে বাংলার পণ্ডিত মানুষেরা নেপালে, তিব্বতে চলে গিয়েছিলেন।" এ মতই সর্বাধিক মান্য।

(গ) চর্যা গবেষক তারাপদ মুখোপাধ্যায় মনে করেন যে, এক সময়ে নেপালে বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলা লিপিতে পুথি লিখেছেন এবং তাই তিনি বলেছেন, - “নেপালে বাংলা অক্ষরে বাঙালি লিপিকরের লেখা পুথির অস্তিত্ব আশ্চর্যের ব্যাপার নয়”।

 

২) 'চর্যা' শব্দের অর্থ কী? এ প্রসঙ্গে যথোপযুক্ত তথ্য দিন।

উত্তর - 'চর্যা' শব্দের মূলত দু'টি অর্থ প্রাধান্য পায়। সেগুলি হল ---

(ক) 'চর্যা' শব্দের সাধারণ অর্থ আচার আচরণ। বিশেষ অর্থ -- মুনি ঋষি যোগী তপস্বীদের সুনির্দিষ্ট আচার আচরণ, -- তাঁদের থাকা, খাওয়া, পরা, কাজকর্ম, ধর্মাচরণ ইত্যাদি -- যেগুলি তাঁর শিষ্য পরম্পরায় মেনে চলেন। তাই চর্যা মানে -- দুষ্কর ব্রতাচরণ।

(খ) চর্যা মানে একশ্রেণির অধ্যাত্ম গীতি -- যাতে সাধু সন্ন্যাসীদের ব্রতাচরণ ও ধর্মকর্ম প্রকাশ পায়। এতে ২ বা ৩ জোড়া চরণ থাকে।

 

৩) চর্যার ভাষার প্রধান ভাষাতাত্ত্বিক পটভূমি যে পশ্চিমবঙ্গ, তার কয়েকটি প্রমাণ দিন।

উত্তর - তার কয়েকটি প্রমাণ নিম্নে দেওয়া হল ---

(ক) গৌণ কর্ম সম্প্রদানের বিভক্তির পরিবর্তে 'ক' বিভক্তির আপেক্ষিক প্রয়োগাধিক্য।

(খ) সাথে অনুসর্গের পরিবর্তে 'সন', 'সঙ্গ'-এর ব্যবহার।

(গ) ৩৯, ৪৯ নং পদ দুটি চর্যায় রূপকের ছলে পূর্ববঙ্গবাসীদের (বঙ্গাল) প্রতি অবজ্ঞা অনুকম্পা মিশ্রিত মনোভাব প্রকাশ।

 

৪) চর্যার কেমন পুথি মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ছেপেছিলেন?

উত্তর - মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যার যে পুথিটি ছেপেছিলেন, সেটি সম্পূর্ণ পুথি নয় -- খণ্ডিত পুথি। প্রাপ্ত পুথিটিতে মোট পাতার নম্বর আছে ১ থেকে ৬৯। তন্মধ্যে হরপ্রসাদ পাননি ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ এবং ৬৬ নং, মোট ৫টি পাতা। এছাড়া, ৬৯ পাতার পর, পুথিতে আর কত পাতা ছিল, তাও জানা যায়নি। আবার এই ৫টি পাতা হারিয়ে যাওয়ার জন্যেই, এই পাতাগুলিতে লেখা ২৩ নং গানের অর্ধেকটি এবং ২৪, ২৫ ও ৪৮ নং গান অর্থাৎ মোট ৩.৫টি গান বা পদ তিনি পাননি। তাই হরপ্রসাদের খণ্ডিত পুথিতে আছে মোট ৬৪টি পাতা, মোট ৪৬.৫টি গান বা পদ। আর আছে প্রতিটি গানের নীচে সংস্কৃত টীকা। অর্থাৎ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই ৬৪টি পাতা সম্বলিত এই ৪৬.৫টি গান বা পদ (টীকা সমেত) যা ছেপেছিলেন --- তারই নাম 'চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়'।

 

৫) চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ দিন।

উত্তর - চর্যাপদের ভাষা যে বাংলা, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ নিম্নে দেওয়া হল ---

(ক) চর্যার ভাষার অধিকাংশ শব্দরূপ বাংলার নিজস্ব শব্দরূপ। যেমন -- 'তরঙ্গেতে হরিণার খুর ণ দীসঅ', 'ঝাণে দিঠা', 'কুম্ভীরে খাঅ'।

(ক) চর্যায় ব্যবহৃত অধিকাংশ প্রবাদই বাংলার নিজস্ব প্রবাদ। যেমন -- 'অপণা মাংসে হরিণা বৈরী', 'জো ষো চৌর সোই সাধী', 'হাঁড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী'। পরবর্তীকালের বাংলা কাব্যে ও জীবনে এগুলি বহু ব্যবহৃত হয়েছে।

(গ) চর্যার যৌগিক ক্রিয়াগুলি বাংলার খাঁটি যৌগিক ক্রিয়া। যেমন -- 'টুটি গেলি' (পদ-৩৭), 'গুণিআ লেহুঁ' (পদ-১২), 'পুচ্ছিন্ন জাণ' (পদ-১), 'ধরণ ণ জাই' (পদ-২)।

(ঘ) চর্যায় নঞর্থক বাক্যাংশ ব্যবহারেও বাংলার নিজস্ব ব্যবহার দেখা যায়। যেমন -- 'ণ জাই' (পদ-২), 'ণ ভুলই' (পদ-১৫)।

 

৬) 'সন্ধ্যা'(সন্ধা) ভাষা কী? চর্যাগীতি থেকে এই ভাষার একটি উদাহরণ দিন।

উত্তর - চর্যাপদের ভাষাকে কেউ কেউ 'সন্ধ্যা' (সন্ধা) ভাষা বলেছেন। এই ভাষা হল ---

(ক) গূঢ়ার্থ প্রতিপাদক একরকমের সাংকেতিক বচন। যার সাধারণভাবে একরকমের অর্থ হয় কিন্ত তার ভেতরের অর্থ হয় অন্যরকম।

(খ) এক একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যেই এই ভাষা চলতে থাকে। সেই গোষ্ঠীর লোকেরাই তার অর্থ বোঝে, অন্যেরা বোঝে না।

(গ) সাধারণত গোপনীয়তা রক্ষার জন্যই এই ভাষা ব্যবহার হয়। যেমন -- "সোনে ভরিতী করুণা নাবী। রূপা থোই নাহিক ঠাবী।।" (পদ-৮)

 

৭) চর্যাপদে কবিদের নামের সঙ্গে 'পাদ' বা 'পা' শব্দের যোগ থাকে কেন? 

উত্তর - 'পাদ' শব্দের অর্থ -- পূজনীয়, পূজ্যবাচী, গৌরব বাচক, যাঁর চরণ স্পর্শ করে শ্রদ্ধা জানানো যায়। 'পাদ' মানে ধর্মগুরু। সমকালে চর্যাকবিরা শিষ্য ভক্ত মণ্ডলীর কাছে পূজনীয় আচার্য বা গুরু হিসেবে মর্যাদা পেয়ে ছিলেন। তাই তাঁদের ভক্ত শিষ্যরা তাঁদের নামের সঙ্গে 'পাদ' বা 'পা' শব্দটি যোগ করে দিতেন। তদনুসারেই মুনিদত্ত টীকা রচনাকালে কবিদের নামের শেষে 'পাদ' বা 'পা' শব্দ যোগ করেছেন।

 

৮) চর্যাপদে ব্যক্তিগতভাবে কাহ্নপাদ বা কাহ্নপা কী ছিলেন? তাঁর রচিত পদসমূহের একটি বৈশিষ্ট্য লিখুন।

উত্তর - ব্যক্তিগতভাবে কাহ্নপাদ বা কাহ্নপা ছিলেন সহজিয়া তান্ত্রিক বৌদ্ধযোগী। তিনি ধর্মশাস্ত্র ও সঙ্গীত শাস্ত্র উভয় দিকেই দক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত পদসমূহের একটি বৈশিষ্ট্য হল --- তাঁর পদগুলিতে নিপুণ কবিত্বশক্তি প্রকাশের পাশাপাশি তৎকালীন সমাজচিত্রও উদ্‌ঘাটিত হয়েছে।

 

৯) 'ভুসুক' নামকরণের কারণ কী? তাঁর রচিত পদসমূহের একটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করুন।

উত্তর - ভুসুক প্রথম দিকে অলস ছিলেন। ভুক্তি (ভু), সুপ্তি (সু), কুটিরে (কু) অবস্থান ছাড়া তিনি কিছু করতেন না বলে, তাঁকে ভুসুক বলা হয় বা তাঁর নাম ভুসুক রাখা হয়। তাঁর রচিত পদসমূহের একটি বৈশিষ্ট্য হল --- তাঁর পদগুলিতে বাঙালি জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।

 

১০) 'তাড়ক' কি কবির প্রকৃত নাম না ছদ্মনাম? উত্তরের স্বপক্ষে যুক্তি দিন।

উত্তর - পণ্ডিতদের ধারণা -- 'তাড়ক' জনৈক চর্যা কবির প্রকৃত নাম নয় -- ছদ্মনাম। এর কারণ :- 

(ক) 'তাড়ক' মানে ফাঁসুড়ে বা খুনি।

(খ) কেউ বলেছেন -- 'তাড়ক' মানে তাড়স্ক, অর্থাৎ কানের গয়না। সুতরাং, ফাঁসুড়ে বা গয়না -- এ রকম অর্থের শব্দটি (তাড়ক) কবির প্রকৃত নাম না-হওয়াই স্বাভাবিক।


** কৃতজ্ঞতা স্বীকার: উপরিউক্ত ১০ টি প্রশ্নোত্তর সৌমদীপ মাইতি দাদার পোস্ট থেকে নেওয়া হয়েছে।


আরও পড়ুন - 

Thank You

For More Update Visit Our Website Regularly:

www.banglasahitto.in 

Contact Us On:

Mail: contact@banglasahitto.in

To join our FB Page - CLICK HERE.

Post a Comment

4 Comments

  1. খুব সুন্দর।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ 🌸❤️

    ReplyDelete
  3. চর্যাপদগুলো লিখিত হয়েছিল বাংলাদেশের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় না-বোধক শব্দ ক্রিয়ার আগে বসে। যেমন: ন যও (যাও নি/যেও না), ন খাও (খাও নি/খেও না), ইত্যাদি। চর্যাসমূহেও ক্রিয়ার আগে বার বার না-বোধক পদ ব্যবহৃত হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ: ভাব ন হোই, অভাব ণ যাই (লুইপা – ভাব হলো না অভাব গেলো না), ধুলি ধুলি পিটা ধরণ ন জাই (কুক্কুরী পা), জোইণি তঁই বিনু খনহি ন জীবমি (গুন্ডরিপা), তিন নচ্ছুপাই হরিণা পিবাই ন পাণী (ভুসুকুপা), ভানুই হ্নু মোহিঅহি ন পইসই (কাহ্নপা)।চর্যাপদের সিদ্ধগুরুদের অধিকাংশই চট্টগ্রামের পন্ডিতবিহার থাকতেন।

    ReplyDelete
  4. শশীভূষণ দাশগুপ্তের সংগ্রহিত ২৫০ টি পদের অবস্থান এখন কোথায়?

    ReplyDelete