বৈষ্ণব পদাবলী থেকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্নোত্তর:
১. বৈষ্ণব পদাবলী
সাহিত্যে ‘মরমিয়া কবি’ হিসেবে কে বিখ্যাত ছিলেন? তিনি কোন যুগের কবি?
- বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের ‘মরমিয়া কবি’ হিসেবে খ্যাত ছিলেন কবি চন্ডীদাস।
তিনি আদি মধ্যযুগের তথা প্রাক - চৈতন্য যুগের কবি ছিলেন।
২. কবি চন্ডীদাস
কোথায় কত খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন?
- কবি চন্ডীদাস বীরভূম জেলার অন্তর্গত নান্নুর গ্রামে (মতান্তরে বাঁকুড়া ছাতনা গ্রামে) জন্মগ্রহণ করেন।
কবি চন্ডীদাস এর জন্ম আনুমানিক ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে।
৩. কবি চন্ডীদাসের
পদ কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিভাবে ব্যাখ্যা করেছেন?
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চণ্ডীদাস কে "দুঃখের কবি" হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি তাঁর প্রেম ভাবনায় লক্ষ করেছেন রসের প্রগাঢ়তা। মিলনেও তাঁর রাধার মধ্যে সুখের অভাব।
কৃত্তিবাস ওঝা বাংলা রামায়ণের আদি কবি |
৪. চন্ডীদাসের প্রেম
ভাবনার অভিনবত্ব কী?
- চন্ডীদাসের পদে প্রেমের সার্থকতা ভোগে নয়, ত্যাগে। দেহকে অবলম্বন করে তা দেহাতিক্রমী। তাই চন্ডীদাসের রাধা আত্মবিসর্জনে তাঁর প্রেম সাধনার পূর্ণতা খুঁজে পায় -
"পিরিতি লাগিয়া পরাণ ছাড়িলে
পিরিতি মিলায়ে তথা"।
৫. চণ্ডীদাসের পদ
রচনার বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে লিখুন।
- চন্ডীদাস আটপৌরে সহজ বাংলা ভাষায় তাঁর পদ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত পদে প্রবাদ - প্রবচন, উপমা - রূপকের ব্যবহারে লোকায়ত ভাবনার প্রকাশ। অলংকারের জাঁকজমক সেখানে প্রায় নেই বললেই চলে।
৬. বাংলা সাহিত্যে
চন্ডীদাস সমস্যা কী?
- বাংলা সাহিত্যে ‘চন্ডীদাস’ ভণিতায় একাধিক কবির পদ পাওয়া যায়। যেমন - বড়ু চন্ডীদাস, চন্ডীদাস, দ্বিজ চন্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস প্রমূখ। এর ফলে চন্ডীদাস আসলে ক - জন তা নিয়ে যে সমস্যার সূত্রপাত তা-ই চন্ডীদাস সমস্যা নামে পরিচিত।
বিজয় গুপ্ত এবং তাঁর রচিত "পদ্মাপুরাণ" |
৭. "সায়াহ্ন
সমীরণের দীর্ঘশ্বাস" - কার পদ সম্পর্কে কে এই মন্তব্য করেছেন?
- সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চন্ডীদাসের পদ সম্পর্কে উদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন।
৮. ব্রজবুলি ভাষা
কি?
- ব্রজবুলি ব্রজধামের ভাষা নয়। এ হল বাংলা, অসমীয়া, মৈথিলী ও অবহট্ঠ ভাষার সমন্বয়ে তৈরি হওয়া একটি কৃত্রিম ভাষা।
৯. কে, কোথায় নিজেকে
‘খেলন কবি’ হিসেবে বিশেষিত করেছেন?
- কবি বিদ্যাপতি "কীর্তিলতা" কাব্যে নিজেকে 'খেলন কবি' হিসেবে বিশেষিত করেছেন।
১০. ভাবসম্মিলন এর
পদে বিদ্যাপতির দক্ষতা আলোচনা করুন।
- মাথুরের পদে বিদ্যাপতির রাধা যে ভাব গভীরতা তা আরও সংহত হয়েছে ভাব সম্মিলনের পদে। রাধা নিজেকে সাজিয়ে তুলতে চেয়েছেন কৃষ্ণের আগমনের অপেক্ষায়। এবং কল্পনার জগতে কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর নিত্য মিলন। রাধার দেহ পার্থিব প্রেমভাবনা ভাবসম্মিলনের পদের অন্তরময়তায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
সৈয়দ আলাওল : আরাকান রাজসভার কবি |
১১. প্রার্থনা পর্যায়
বিদ্যাপতির অভিনবত্ব কী?
- প্রার্থনা পর্যায় রাধা - কৃষ্ণের প্রেম সম্পর্কের বাইরে গিয়ে কবি ব্যক্তিগত ভক্তি ভাবনাকে আশ্রয় করেছেন। প্রাক - চৈতন্য যুগের কবি বিদ্যাপতি এখানে কৃষ্ণের ঐশ্বর্য ভাবের কল্পনা করেছেন এবং কৃষ্ণের চরণতরী কে আশ্রয় করে এই জগৎ থেকে মুক্তি প্রার্থনা করেছেন -
"তুয়া পদপল্লব করি অবলম্বন
তিল এক দেহ দীনবন্ধু"।
১২. কবি বিদ্যাপতি
তাঁর সাহিত্য রচনায় কোন কোন রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন?
- কবি বিদ্যাপতি তাঁর সাহিত্য রচনায় মিথিলার একাধিক রাজার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। বিভিন্ন রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত বিদ্যাপতির গ্রন্থ গুলির একটি তালিকা নিম্নে দেওয়া হল –
রাজার নাম |
রচিত
গ্রন্থ |
কীর্তি সিংহ দেবী সিংহ শিব সিংহ পদ্ম সিংহ ও বিশ্বামদেবী নরসিংহ ও ধীরমতী পুরাদিত্য ভৈরব সিংহ |
কীর্তিলতা ভূপরিক্রমা কীর্তিপতাকা, পুরুষপরীক্ষা শৈব - সর্বস্বহার,
গঙ্গাবাক্যাবলী দানবাক্যাবলী,
বিভাগসার লিখনাবলী দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী |
১৩. কে, কত সালে
"বিদ্যাপতির পদাবলী" প্রকাশ করেন?
- সারদাচরণ মিত্র ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে "বিদ্যাপতির পদাবলী" প্রকাশ করেন।
মালাধর বসু : ভাগবতের প্রথম অনুবাদক |
১৪. "মহাজন
পদাবলী" কী? কে কবে এটি প্রকাশ করেন?
- "মহাজন পদাবলী" বিদ্যাপতি রচিত পদ - সংকলন।
১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে জগবন্ধু ভদ্র "মহাজন পদাবলী"র প্রথম খন্ড প্রকাশ
করেন।
১৫. কবি বিদ্যাপতি
কে 'অভিনব জয়দেব' বলার কারণ কী?
- বিদ্যাপতির পদ সাহিত্যে জয়দেবের পদের ধ্বনি ঝংকার স্পষ্ট শোনা যায়। ভাবের দিক থেকে এই সাদৃশ্য বর্তমান। সেই কারণেই কবি বিদ্যাপতি কে 'অভিনব জয়দেব' বলা হয়।
১৬. কে, কোথায় কবি
বিদ্যাপতির প্রতিভাকে 'Cosmic Imagination' বলেছেন?
- শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রচিত "বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা" গ্রন্থে বিদ্যাপতির কবি প্রতিভা কে 'Cosmic Imagination' বলে মন্তব্য করেছেন।
১৭. কবি বিদ্যাপতি
কে 'কবিসার্বভৌম' বলা হয় কেন?
- ভূগোল, ইতিহাস, ন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্র, প্রকৃতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে রচনা এবং বৈষ্ণব সাহিত্য রচনায় দক্ষতার জন্য এককথায় নানা শাখায় অদ্বিতীয় প্রতিভার জন্য বিদ্যাপতি কে 'কবি সার্বভৌম' বলা হয়।
মুকুন্দ চক্রবর্তী : “চণ্ডীমঙ্গল” কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি |
১৮. বিদ্যাপতি মিথিলার
কোন রাজবংশের সভাকবি ছিলেন? তার কোন গ্রন্থে সমকালীন ইতিহাস এর পরিচয় পাওয়া যায়?
- কবি বিদ্যাপতি মিথিলার ঔইনীবার বা কামেশ্বর রাজ বংশের সভাকবি ছিলেন।
বিদ্যাপতির "কীর্তিলতা" গ্রন্থে যুদ্ধের ফলে সমাজের তৎকালীন বিপর্যয়ের
কথা বর্ণিত হয়েছে।
১৯. বিদ্যাপতির কবিতা
কে “দূরগামিনী বেগবতী তরঙ্গসঙ্কুলা নদী” হিসেবে বর্ণনা করেছেন?
- সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কবি বিদ্যাপতির পদ সম্পর্কে প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি করেছেন।
২০. বিদ্যাপতি পরবর্তী
বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির প্রভাব আলোচনা করুন।
- চৈতন্য পরবর্তী যুগের কবি গোবিন্দ দাসের রচনায় বিদ্যাপতির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাই তাঁকে 'দ্বিতীয় বিদ্যাপতি' বলা হয়। সপ্তদশ শতকে 'ছোট বিদ্যাপতি' নামে এক কবির বৈষ্ণব পদ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী" তেও বিদ্যাপতির প্রভাব স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।
বাংলা সাহিত্যে অপ্রধান মঙ্গলকাব্য ও কবি |
২১. বিদ্যাপতির রচনাশৈলীর
বৈশিষ্ট্য আলোচনা করুন।
- বিদ্যাপতির পদাবলী তে ছিল শব্দ সৃষ্টির নিপুণতা, অলংকারের ঐশ্বর্য এবং ছন্দ ব্যবহারের কুশলতা। উৎপ্রেক্ষা ব্যতিরেক, অতিশয়োক্তি ইত্যাদি অলংকারের অসাধারণ প্রয়োগ রয়েছে বিদ্যাপতির পদে। শব্দ প্রয়োগে ধ্বনিময়তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবি। আবার শব্দ দিয়ে তৈরি করেছেন চিত্রকল্পও। মণ্ডনকলার অসামান্য নিদর্শন বিদ্যাপতির পদ।
২২. নৈমিষা অরণ্যে
থাকাকালীন বিদ্যাপতি কোন গ্রন্থ রচনা করেন?
- নৈমিষা অরণ্যে থাকার সময়ে মিথিলা থেকে নৈমিষা অরণ্য পর্যন্ত ভূভাগের বিবরণ দিয়ে বিদ্যাপতি "ভূপরিক্রমা" নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন।
২৩. 'বিদ্যাপতি বাঙালি
কবি নন' - কে, কত সালে প্রথম তা প্রমাণ করেন?
- রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রমাণ করেন যে, বিদ্যাপতি বাঙালি কবি নন।
ভারতচন্দ্র রায় - মঙ্গলকাব্য ধারার শ্রেষ্ঠ কবি |
২৪. "আমরা বাঙালির
ধুতি চাদর পরাইয়া মিথিলার বড় পাগড়ী খুলিয়া ফেলিয়া তাঁহাকে আমাদের করিয়া লইয়াছি" - কে, কার সম্পর্কে কোথায় এই মন্তব্য
করেছেন?
- দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর "বঙ্গভাষা ও সাহিত্য" গ্রন্থে বিদ্যাপতি সম্পর্কে প্রশ্নোক্ত মন্তব্যটি করেছেন।
২৫. কোন কোন বৈষ্ণব
পদ সংকলনে বিদ্যাপতির পদ স্থান পেয়েছে?
- "ক্ষণদাগীতচিন্তামণি", "পদামৃতসমুদ্র", "পদকল্পতরু" ইত্যাদি বৈষ্ণবীয় পদসংকলনে বিদ্যাপতির অজস্র পদ স্থান পেয়েছে।
- কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর "চৈতন্যচরিতামৃত" গ্রন্থে লিখেছেন -
“চন্ডীদাস বিদ্যাপতি রায়ের নাটকগীতি
কর্ণামৃত শ্রীগীতগোবিন্দ।
স্বরূপ রামানন্দ সনে মহাপ্রভু রাত্রিদিনে
গান শুনে পরমানন্দ”।।
এ থেকেই বোঝা যায় শ্রীচৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।
২৭. চন্ডীদাসের সঙ্গে
বিদ্যাপতির পার্থক্য নিরূপণ করুন।
- চন্ডীদাস পাণ্ডিত্য বর্জিত, সহজ-সরল গ্রাম্য ভাষায় রাধা - কৃষ্ণ বিষয়ক পদ লিখেছেন। অন্যদিকে বিদ্যাপতি রাজসভার কবি হওয়ায় তাঁর রচনায় বাকবৈচিত্র ও মন্ডলকলার বৈচিত্র বর্তমান। রবীন্দ্রনাথের মতে - "বিদ্যাপতি সুখের কবি, চন্ডীদাস দুঃখের কবি"। চন্ডীদাস গভীর এবং ব্যাকুল বিদ্যাপতি নবীন এবং মধুর।
তথ্যঋণ: SSC বাংলা শিক্ষক – ড. অমল পাল, ড. প্রিয়তোষ বসু (ছায়া প্রকাশনী)
আরও পড়ুন -
Thank You
Visit our Educational Website Regularly for More Update:
Contact Us On:
Mail: contact@banglasahitto.in
To join our FB Page - CLICK HERE.
0 Comments